উত্তর পর্বঃ চরিত্র চিত্রণ
গল্পের চরিত্র সংখ্যা ৬ এবং ৩ স্তরীভূত। প্রথম স্তরের চরিত্র সংখ্যা ৩, যারা রক্ত সম্পর্কীয় এবং গল্পের মূল স্রোতধারী। দ্বিতীয় স্তরের চরিত্র সংখ্যা ১, যে রক্ত সম্পর্কীয় নয় কিন্তু মূল সংসারে তার অবস্থান অনিবার্য। তৃতীয় স্তরের চরিত্র সংখ্যা ২, যারা অন্যগোত্রীয়, একটি জীবন্ত অন্যটি জড়। অন্য গোত্রীয় হলেও দিনে দিনে সময়ের পাতলা পর্দায় অভিশ্রবণ প্রক্রিয়ায় মূল সংসারে অবিচ্ছিন্নভাবে মিশে গেছে। গল্পের পাত্র-পাত্রীদের অবস্থান শংকরের একটি আধপুরনো ফ্ল্যাট বাসার দো’তালায়। সদর দরজা খুলে লম্বা করিডোর। গুণে গুণে ৭ কদম এগুলে বাঁ দিকের রুমটির দুটো খাটের একটি আবু রইসের, অপরটি আবু রইসের স্ত্রী মহীতুনের। মাঝ দেয়ালে দরজা কেটে অপর একটি রুম তাদের একমাত্র ছেলে পিয়ালের, যার অপর দরজা করিডোরের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। সদর দরজা খুলে শুরুতেই ডান দিকে যে রুমটি সেটি সামাজিক চাহিদার গড় হিসেবে পীত্বর্ণের মাটি আর এক সেট বেতের বসার সরঞ্জাম নিয়ে একটি ড্রইং রুম। উত্তর-পশ্চিম কোণায় নক্শা কাটা একটি মাটির কলসী সাইড টেবিলে বসানো। পাশের দেয়ালেই টানানো রয়েছে পিয়ালের জন্মদিনের কেক কাটার দৃশ্য সম্বলিত একটি ছবি। ছবিটি ২০"X১৪" সাইজের এনলার্জ। কেকের বুক জুড়ে অস্পষ্ট ওঝঞ ইওজঞঐ উঅণ ঙঋ চওঅখ- এর অক্ষরগুলোর উপর পিয়ালের চক্চকে ছুরি ধরা ডান হাত। একটু ঝুঁকে পিয়ালকে কেক কাটতে সহযোগিতা করছে মহীতুন এবং কেউ ছবি তুলছে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞাত আবু রইস অসাধারণভাবে মহীতুনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গল্পের সময় এ ছবির সময়কালের ১৮ বছর পর। সময়ের ব্যবধান যতটুকু, সেখানে বাহ্যত সামাজিক পট পরিবর্তন তেমন উল্লেযোগ্য না হলেও ছবির চরিত্রগুলোর জীবন প্রণালীর পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও নির্ধারিত সূত্র ধরে আরও একাধিক চরিত্রের সংমিশ্রণ ঘটেছে সময়ের দীর্ঘসূত্রিতায়।
আবু রইস গল্পের অচল চরিত্র। মনোগত এক ধরনের সচলতা থাকলেও দেহগত অচলতা গল্পকে কিছুটা স্থিরতা দান করেছে সত্য কিন্তু এ আবু রইসই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ১৯৭৪ এ স্কুটারটা বরিশাল-চাখার ১৪ কিলোমিটার সমতলভূমি থেকে বেশ উঁচু রাস্তার মাঝামাঝি শেখেরহাট পেরিয়ে একটা ছোট ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে খাদে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটা তার চোখে এখনো একটা ফ্রীজশট্ ছবির মত অনড়, কিন্তু প্রায়শই নড়ে-চড়ে ওঠে। মহীতুন গল্পের দ্বিতীয় চরিত্র, সচল। আবু রইসের এ অকাল ও অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা এবং তৎপরবর্তী অসাড়তা মহীতুনের মনোগত এক ধরনের স্থবিরতার কারণ হলেও তিনি দেহগতভাবে সচল। স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার পরের বছর যখন আবু রইসের পঙ্গুত্বের প্রতি মমত্ববোধ কিংবা গভীর ভালোবাসার আস্তরিত শোকটা কিছুটা কমে গেছে অথবা কমে যাওয়ার কথা তখন সংসার থেকে দ্বিতীয়বার বিয়ের প্রস্তাবকে পাথর অনভূতি নিয়ে অনড় ও মনঃশক্তি প্রয়োগে ফিরিয়ে দিয়ে আবু রইসকে নিয়েই সংসার করা সিদ্ধান্ত মহীতুনকে আবু রইসের কাছে দেবীর মর্যাদায় আসীন করে তোলে। গল্পের তৃতীয় চরিত্র তাদের একমাত্র সন্তান পিয়াল। সচল। কলেজে পড়ে, চানক্য সেনের পুত্র পিতাকে কিংবা লরেঞ্জের লেডী চ্যাটার্লিজ লাভার পড়ে। সে তার বাবার দুর্ঘটনা এবং তৎপর পরিণতির কথা ভেবে ৬ এবং দেখে অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু তার মার এ স্বরিুদ্ধ বা দেবীতুল্য জীবন প্রণালীকে কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারে না। পিয়াল সেল্ফ ডিপেনডেন্সিকে স্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে-নির্দিষ্ট সময় পর প্রত্যেক মানুষই একা। বাড়তি যা পায় বা পাওনা তা প্রকারান্তরে সাহায্য কিংবা ক্রীত। দ্বিতীয় স্তরের সচল চরিত্র যা পায় বা পাওনা তা প্রকারান্তরে সাহায্য কিংবা ক্রীত। দ্বিতীয় স্তরের সচল চরিত্র মাধু। মাধু এ সংসারের কেউ নয় কিন্তু আবু রইসের একটা জীবনের সমান বয়সে সে এ সংসারের হয়ে গেছে। আবু রইসের দেখাশুনা করে মাধও। ১০ গজের মধ্যে তার অবস্থান। ফাই-ফারমাস, ইউরিনার পরিষ্কার, চাদর বিছিয়ে দেয়া, লুঙ্গি ঠিক করা প্রভৃতি নানাবিধ কর্ম তাকে সম্পাদন করতে হয়। মহীতুন আবু রইসের ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে নিকটতর হলেও কোন কোন সময় মাধুর কাছেও আবু রইসের কোন গোপনীয়তা থাকে না। তৃতীয় স্তরের প্রথম চরিত্র একটি ইউক্যালিপটাস গাছ। অচল। বয়েসী কিন্তু অবর্ধিষ্ণু। আবু রইসের বাসা ও পাশের ৪ তলা বাসাটির মাঝখানে ৩ ফুট ফাঁকা জায়গাটিতে এ গাছটির অবস্থান। গাছটি না পেয়েছে জল, না পেয়েছে আলো। পাশের ৪ তলা ফ্ল্যাটটি ওঠার আগে গাছটি মনে-প্রাণে প্রার্থনা করেছে কেউ তাকে স্থানান্তর করুক কিন্তু কেউ তা অনুভব করল না। এক ধরনের অপুষ্টিজনিত বন্ধ্যাত্ব নিয়ে কোন রকমে আবু রইসের খাটের ডান পাশ সংলগ্ন জানালা বরাবর এসে গাছটি থেকে গেছে। যেন অতটুকু উঠে আসা প্রয়োজন ছিল গাছটির। ফলে ইউক্যালিপটাস গাছটির জীবন ও আবু রইসের জীবন একই সমান্তরালে অনুমিত হয়। ভিন্ন গোত্রের হলেও নিয়তি কিংবা সময় যেন দুটি জীবনের মধ্যে সাজুয্য এনে দিয়েছে। পরবর্তী সময় এই ইউক্যালিপটাস গাছটির সাথে আবু রইসের নিত্যকার দেখা, শোনা ও জানা এবং পরবর্তী কর্মাদি গল্পের মূল বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। গল্পের সর্বশেষ চরিত্র করিডোরের শেষ প্রান্তে দেয়ালে টানানো একটি দেয়াল ঘড়ি। জড় এবং অচল। অচল বলতে এ ক্ষেত্রে স্ব-ইচ্ছায় স্থানান্তর ক্ষমতাহীনতাকে বুঝতে হবে। ৮ বছর ধরে ঘড়িটা ঐ একই জায়গায় নিজ অবস্থান থেকে একটুও নড়েনি। কিন্তু প্রতি ঘণ্টা পর পর বিভিন্ন মাপের ঘণ্টা ধ্বনিগুলো এতদিনে প্রাণ পেয়েছে বলে মনে হয়। ঘণ্টাগুলো যেন বিভিন্ন চরিত্রগুলোর সাথে কথা বলে। ঘুম থেকে ডেকে তুলে, ঘুমুতে যেতে বলে, পিয়ালকে কলেজে যেতে বলে, মহীতুনকে অফিসের কথা বলে এবং আবু রইসকে ঔষধ খেতে বলে। অর্থাৎ সারাদিন ধরেই ঘড়িটা যেন নিজ থেকেই তার কর্তব্য পালন করতে যেয়ে একটা জীবনময় আবহ তৈরি করে রেখেছে। যে আবহের ভেতর মহীতুনের ৯-৫টা অফিস জড়িয়ে আছে। হাতের ঘড়ির সময় থেকে বিশ^স্ত এই দেয়াল ঘড়িটার ৭টার ঘণ্টা। ৭টার ঘরে পড়ে থাকা ঘড়ির লম্বা কাঁটা যেন মহীতুনের লম্বা সিঁথিতে লম্বালম্বি পড়ে থাকে।
মধ্যপর্বঃ সংশ্লেষায়িত জীবন প্রণালী
দেয়াল ঘড়িটা সাড়া বাড়ির দেয়ালে ঢং ঢং পুরনো শব্দলয়ে ভোর ৫টার খবর পৌঁছে দেয়। এ সংবাদ গত ৮ বছর ধরে নিত্যকারভাবে আবু রইস পায়।
কারণ আবু রইসই একমাত্র চরিত্র, বরাবরই যার ঘুম ভাঙ্গে ঘড়িতে ৪ এর ঘণ্টা বাজলে। অন্য সবাই তখন গভীর নিদ্রামগ্ন। ঘরের এক কোণে টেবিল ল্যাম্পের হলতে ভারি কাপড়ের ভাঁজ সরিয়ে আসা ০৫ ভোল্ট এর এক ধরনের মায়াবী আলো সারা ঘরময় সমান ঘনত্বে ছড়িয়ে থাকে। চারপাশ জুড়ে প্রচন্ড নীরবতা। মহীতুন ও পাশের রুমে পিয়ালের মাঝে-মধ্যে পাশ পাল্টানোর শব্দ এবং সংলগ্ন জানলার ওপারে হালকা বাতাসে ইউক্যালিপটাসের পাতার কিছুটা মর্মর ধ্বনি ছাড়া নীরবতার ছেদ টানার মত আর কোন শব্দ থাকে না। তাই ৪টার ঘণ্টার বেশ কিছুক্ষণ পর যখন একাধারে ৫টি ঘণ্টা পড়তে থাকে তখন আবু রইসের কাছে মনে হয় ৫টি রেসের ঘোড়া যেন একের পর এক মুক্তির আনন্দে সারা ঘরময় ছুটে বেড়াতে থাকে।
আবু রইসের রক্তের ভেতর একটা গতি সঞ্চারিত হয়ে আবার অল্পক্ষণের মধ্যেই থিতিয়ে আসে। প্রথম দিকে এ ধরনের সৃষ্ট অনুভূতিগুলো দীর্ঘক্ষণ ধরে কাজ করত। কিন্তু দিনে দিনে এ সকল অনুভূতি তার নিজের মতই শুকিয়ে শুকিয়ে নির্জীব শেকড়ে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। দুর্ঘটনাটা তেমন মারাত্মক ছিল না। মুখোমুখি কোন ভারি যান এর সাথে সংঘর্ষ ছিল না। ভারসাম্য হারিয়ে স্কুটারটি কেবল খাদে গড়িয়ে পড়ছিল। এ ধরনের দুর্ঘটনার ক’জনের চামড়া ছিলে যাওয়ার কিংবা হাত পা মচকে যাওয়া বা ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আবু রইসের ক্ষেত্রে আঘাতটা হয়ে পড়ল শক্ত। তা করোটি ¯œায়ুতে মারাত্মকভাবে আঘাত করেছে। মেরুদন্ডের কয়েকটি করেশুকা নিজ স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। ফলে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়েছে। কোন কোন ক্রিয়াযোগ্য সংবেদী তন্তু বাহ্যিক কোন অনুভূতিকে মস্তিস্কে পৌঁছে দিতে সক্ষম হলেও মটো আজ্ঞাবাহী স্নায়ুর বৈকল্যের কারণে আবু রইসের শরীরের প্রত্যঙ্গগুলো পরবর্তী ক্রিয়া প্রদর্শনে সক্ষম হয় না। শুধুমাত্র সতেজ মুখমন্ডল ছাড়া বাকী আবু রইস অনেকটা জড় পদার্থের মতই বিছানায় পড়ে থাকে। তার দু’চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসা দৃষ্টিতে এক প্রকার মায়াজাল আচ্ছন্ন করে রাখে চারদিক। হাত দুটো শুকিয়ে লতানো গুল্ম শাখার মত বিছানায় নেতিয়ে থাকে। একটা কাটা লুঙ্গিতে কোমর থেকে নিচ অংশ ঢেকে রাখা এবং নিচ থেকে কেথিটারের নল ইউরিনারে প্রবেশ করানো। বসে থাকা কিংবা হুইল চেয়ারে বসে কিছুটা নড়াচড়া কোনটাই তার পক্ষে সম্ভব হয় না। শুয়ে শুয়েই খেতে হয় এবং খাইয়ে দেয় মাধু। অত্যন্ত যত্ন করে ছোট্ট শিশুর মত চামচে খাবার নিয়ে মুখে তুলে দেয়। গ্লাসে রাবারের নল ডুবিয়ে চুষ চুষ করে পানি তুলে নেয় আবু রইস।
আবু রইস দোমেনিক লাপিয়েরের দি সিটি অব জয় পড়ে স্তেভান থেকে মনোবল নিতে চেষ্টা করে। জীবনযুদ্ধে বার বার আঘাত প্রাপ্ত হয়েও হতাশাগ্রস্থ না হয়ে পুনরায় শুরু করার যে শক্তি স্তেভান পাঠককে দেয় তা আবু রইস নিতে চায়। কিন্তু আবু রইস পারে না দৃঢ়তর করতে। পারে না একবার তার এ চার দেয়ালের বাইরে গিয়ে একটা বিকেলকে উপভোগ করতে, কুয়াশা ভেজা শীতের ভোরকে পায়ে মাড়িয়ে আসতে। তার ডানপাশ সংলগ্ন জানালার পর্দা সরালে যে বর্গাকৃতি আকাশ, এখন তাকে আগ্রহী করে না। দিনে দিনে তার সম্প্রসারিত সকল আগ্রহ শুটিয়ে এসেছে।
জানলা ছুঁই ছুঁই যে ইউক্যালিপটাস গাছটি, এক ধরনের পঙ্গু জীবন নিয়েই বেঁচে আছে- একসময় তার প্রতিই আবু রইস অধিক আগ্রহী হয়ে পড়ে। উদ্ভিদ ও উদ্ভিদের জীবন সম্পর্কে জানার আগ্রহ, এ থেকে বেশ পড়াশুনা অতঃপর উদ্ভিদ ও মানুষের জীবন সংশ্লিষ্টতা নিয়ে চিন্তা তার প্রতিদিনের কর্মে রূপান্তরিত হয়। উপাত্ত হিসেবে তার সামনে ইউক্যালিপটাস গাছটি, যার সাথে আবু রইস নিজের জীবনের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পায়। দুর্ঘটনা, স্থবিরতা, অবর্ধিষ্ণু, ক্রমশঃ শুকিয়ে যাওয়া, ক্ষীণ অনুভূতি........। ধীরে ধীরে এ ধরনের চিন্তা, ভাবনা, দেখা ও খোঁজা অতি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়লে আবু রইসের একেবারেই ব্যক্তি জীবনের বাইরে যতটুকু জীবন সেখানে ইউক্যালিপটাস গাছটি সংশ্লেষায়িত হয়ে পড়ে।
তার যে ক’টি শাখা-প্রশাখা জানলা বরাবর অবস্থান নিয়েছে এবং মৃদু বাতাসে হালকা পত্র সমষ্টিতে বিমূর্ত শব্দ সৃষ্টি করে সেগুলো ইদানিং আবু রইসের কাছে মূর্ত হয়ে উঠছে। ভোরে ঘড়িতে যখন ৪ এর ঘণ্টা পড়ে তখন চোখ মেলেই ইউক্যালিপটাসের একটি শাখা তার জানালার গ্রীল বেয়ে প্রবেশের চেষ্টারত লক্ষ্য করে। দুটো মানবীয় চোখ ও দুটো উপর-নিচ ঠোঁট কোন পাতায় দৃশ্যতৎ হতে দেখে, যদিও সে নির্দিষ্ট কোন পত্র-শাখায় সনাক্ত করতে পারে না। ক’দিন আগে ইউক্যালিপটাস গাছ সংক্রান্ত একটি ঘটনা তাকে বিস্মিত ও আতঙ্কগ্রস্ত দুই-ই করেছে। ঘটনাটি স্পষ্টতঃই বাস্তবিক নয় তা জেনেও আবু রইস ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করে অতটুকু বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, একটা মায়াজালে আচ্ছন্ন কোন অতিপ্রাকৃত সংশ্লেষণ প্রণালী থেকে সে নিজেকে কোনমতেই বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না। ঘটনাটি নিন্মরূপ:
সময়টা বৃহস্পতিবার বিকেল। আকাশে মেঘ, তাই পর্যাপ্ত আলো নেই। তবে বৈদ্যুতিক বাতি জে¦লে দেয়ার মত অবস্থা নয়। মহীতুন অফিস থেকে তখনও ফেরেনি। পিয়াল বেরিয়েছে অল্পক্ষণ হয়। পরিবেশেটা কিছুটা নীরব ও নিষ্প্রাণ। আবু রইসের দৃষ্টি জানলার গ্রীলের ফাঁক গলে মেঘলা আকাশ ছোঁয়া। জানলার বাইরে ইউক্যালিপটাসের একটি শাখা জানলার গ্রিলে ঝাপটে পড়ে। আবু রইসের দু’চোখ মেঘলা আকাশ থেকে বিচ্যুত হয়ে ইউক্যালিপটাসের পত্র-শাখায় ফিরে আসে। অমনিতে সনাক্ত করতে সে অপারগ অথচ স্পষ্টতঃই দুটি চোখ ও উপর-নিচ দুটো ঠোঁটের নিঃসৃত মৃদু হাসির অবয়ব আবই রইসকে স্পর্শ করে। আবু রইস প্রথমে ভয় এবং তৎপর ঘটনাক্রমে সংশ্লেষায়িত হয়ে পড়ে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় ইউক্যালিপটাস গাছটি জানলা বেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। অত্যন্ত জড়োসড়ো সয়ে গাছটি তার সামনে মহীতুনের বিছনায় মুখোমুখী বসে। একটি শুকনো শাখা অনেকটা আবু রইসের হাতের মতই এগিয়ে দিলে উভয়ে হাত মেলায়। অতঃপর গাছটি আবেগ-আপ্লুত হয়ে তার জীবন বৃত্তান্ত শুরু করে।
যেদিন থেকে আবু রইসের পাশের ৪ তলা ফ্ল্যাট বাসাটির কাজ শুরু হয় সেদিন থেকেই তার একটা প্রার্থনা ছিল, কেউ যেন তাকে এসে স্থানান্তর করে। কিন্তু কেউ তার প্রার্থনা শুনল না। তাই পরবর্তী সময় যা হবার তা-ই হল। ইট-কাঠ-বাঁশ-সুরকী নিক্ষেপিত হল তার উপর। কেউ তার শাখা ভেঙ্গে দিল, কেউ পাতা ছিড়ে নিল, কেউ বা তার গায়ের চামড়া ছিঁড়ে আহত করল। কেউ এক বালতি পানি দিল না। একটু যত্ন করল না, একটু চিকিৎসা করল না। ফলে ইউক্যালিপটাস গাছটি ক্রমশঃ নিজের ভেতর একধরনের পঙ্গু জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল। তার মৃত্যু হল না সত্য কিন্তু ঠিক বেঁচে থাকাও হল না। বরং দু’ফ্ল্যাটের মধ্যবর্তী একটি অনুপোযোগী পরিবেশে তাকে নিজের ভেতর কুকঁড়ে-মুচড়ে যেতে হল। অত্যন্ত ধীরে ও আবেগায়িত ইউক্যালিপটাসের এই বর্ণনার সাথে আবু রইসকে অন্বিষ্ট হয়ে পড়তে হয় অনেকটা স্বাভাবিক ভাবেই। উপরিস্থিত বর্ণনার পর অল্পক্ষণের জন্য ছেদ পড়ে এবং এ মধ্যবর্তী সময়টুকুতে আবু রইসের দুঃখবোধ ও ইউক্যালিপটাসের দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে নেমে আসে, সাথে প্রসঙ্গান্তর হয় এভাবে আপনি আছেন বলেই আমার বেঁচে থাকা আবু রইসের শ্রুত-ইন্দ্রীয় স্পষ্ট শুনতে পায় তার এ কথা। সত্য-মিথ্যার দ্বিধা তাকে কিছুটা নড়েবড়ে করলেও পরবর্তী কথার জন্য অপেক্ষা করে। স্পষ্টতঃই একটি মনুষ্য অবয়ব। কোন একটি পাতায় দৃশ্যতঃ দুটি চোখ অন্য পাতায় উপর-নিচ দুটো ঠোঁট স্পষ্টতঃই নড়ে ওঠে। আপনি আছেন বলেই আমার বেঁচে থাকা আমার ও আবু রইস অনেকটা অজ্ঞাতসারেই ইউক্যালিপটাসের সাথে প্রথমবারের মত এ বাক্য বিনিময় করে। অতঃপর সংসারের অন্যান্য চরিত্রগুলোর মত এ গাছটিও তার প্রতিদিনের দেখা-শোনা-জানা ও বলার কর্মপ্রণালীর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়ে। দেয়াল ঘড়িতে ৫টা বাজার ৫টি ঘণ্টা ৫টি রেসের ঘোড়ার মত এখনও সারা ঘরময় দ্রুত ছুটাছুটি করছে। শুরুতে ঘোড়াগুলো একেবারেই তার সম্মুখ দিয়ে প্রথম দৃশ্যময় ও পরে ক্রমশঃ দূরবর্তী হয়ে দৃশ্যান্তর হচ্ছে বলে শব্দগুলো প্রথমে স্পষ্ট ও পরে শুধুমাত্র অনুভূতি সংলগ্ন কম্পন সৃষ্টি করছে। ঘরের এক কোণে টেবিল ল্যাম্পের হলদে ভারি কাপড়ের ভাঁজ সরিয়ে বেরিয়ে আসা ০৫ ভোল্ট এর এক ধরনের মায়াবী আলো সারা ঘরময় সমান ঘনত্বে ছড়িয়ে আছে। আবু রইসের সমস্ত দৃষ্টি তরলায়িত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহীতুনের উপর। মহীতুনের উপর তার দৃষ্টির তরল প্রলেপ ক্রমশঃ উপরে এগোয়। উরুতে কাপড়ের ভাঁজ, ভাঁজ সরে হলুদ আলোতে ফুটে থাকা পেটের মসৃণ ত্বক, উন্নত স্তন, গ্রীবা, ঠোঁট, নাক, চোখ, বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন আঁচল, চুল। খানিকক্ষণ পরই মহীতুনের ঘুমে প্রথমবারের মত ধ্বস নামা এবং অতঃপর নির্দিষ্ট কর্মাদির ভেতর অপ্রাপ্তির ধুয়ো মেশা যাবতীয় আকাক্সক্ষাগুলো পরিস্ফুটিত হতে থাকলে আবু রইসের বেঁচে থাকার আগ্রহগুলো ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলে পড়তে শুরু করে। আবু রইসের শরীর ঘেমে উঠে। বিছানার চাদর ভিজে চপচপ হয়। স্বচক্ষে প্রতিদিন মহীতুনের কামপ্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি প্রক্রিয়ার প্রত্যক্ষণে নিজের প্রতি অক্ষমতার সংশ্লেষণ নিজের অনাগ্রহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আবু রইস অত্যন্ত সন্তর্পণে অচল আবু রইসের নিঃসাড় দেহ-মন থেকে অন্য এক সচল আবু রইসকে পৃথক করে। সে ওঠে, বসে এবং দাঁড়ায়। অতঃপর ভেজানো দরজার খিলে হাত রাখে। অমনি মহীতুন আবু রইসকে জাপটে ধরে। একজনের পালিয়ে বেড়ানোর মনোবৃত্তি, অন্যজনের ক্ষুধা নিবৃত্তির মনোবৃত্তি। সে ক্ষুধার কোন বিকল্প নেই। মহীতুনের গা থেকে ততক্ষণে সকল আচ্ছাদন খড়ে পড়ে। দু’পা জড়িয়ে ধরে উর্ধ্ব উত্থিত মহীতুনের দৃষ্টির রশি আবু রইসের সারা শরীর সরীসৃপের মত পেঁচিয়ে ধরে। তারপর আবু রইস-এর পদ চুম্বন এবং নিসিক্ত কামরসনেশা মহীতুনের অধর ধীরগতিলয়ে উপরে উঠে আসে। আবু রইস টের পায় তার পা সবুজাভ মেঝে থেকে আলগা হচ্ছে ৪ ইঞ্চি, ১ ফুট, ১ গজ। উপরে সিলিংফ্যানের গোরালী থেকে একটা হলুদাভ ফাঁসির রজ্জু তার দিকে এগিয়ে আসে। মহীতুন ক্রমশঃ উন্মত্ত হয়ে ওঠে, মাতাল হয়ে ওঠে, বিকৃত হয়ে ওঠে। চোখের সামনে রশির ঘোরানো প্যাঁচ। প্রায়শ্চিত্তের নীল আলো আবু রইসকে ফাঁসির রজ্জুতে আটকে ফেলে, আর তৎক্ষণাৎ মহীতুনের অট্টহাসির শানানো ছুরি তার দিকে নিক্ষেপিত হলে প্রচন্ড রকম চিৎকার করে ধপাস করে নিচে পড়ে যায় এবং ছুটে পালায় রাজপথ, মাঠ, ঘাট, জমি, নদী, বিল পার হয়ে ছুটে চলে। ছুটতে ছুটতে সে পোঁছে যায় বরিশাল এবং ১৪ কিলোমিটার পার হয়ে নিরাপদ ভূ-খন্ড চাখারের মনিপুরে। এসে আবু রইস দাঁড়ায়। তার চোখের সামনে সবুজ ধানী জমির ক্ষেত। মৃদু বাতাসে দোল খায় কিশোরী ধান গাছের আলুথালু শরীর। আইল ধরে ছুটাছুটি করে মহীতুনের কৈশোরীর বয়স। অতঃপর স্থিরচিত্রের মত মহীতুন স্থির হয় এবং পরিবর্তীত চিত্রে বয়সের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করে আবু রইসের সামনে বিনীত ও আনত ভঙ্গিতে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মাটি খোঁড়ে। সবেমাত্র এম এ পাশ করা সুদর্শন ছেলে তখন আবু রইস। একটা কলেজে ভলান্টারি সার্ভিস এবং বরিশাল-ঢাকা ছুটাছুটি করে চাকুরীর জন্য। মহীতুন তখন কি ভাবতে পেরেছিল একদিন এ তরতাজা ও গতিময় আবু রইস এমনি ভাবে নিশ্চল ও নিস্ফলা হয়ে যাবে? ভাবতে পারেনি। ভাববার অবকাশও মেলেনি। অকষ্মাৎ কিংবা দীর্ঘসূত্রিতা যে ভাবেই হোক যদি মহীতুনের আবু রইসকে ভালো লেগেই থাকে তাহলেও দোষের কিছু নেই। এ ভাবেই নিজেদের আগ্রহ থেকে পারিবারিক আগ্রহ এবং বিয়ে। সংসারে প্রথম বছরই পিয়ালের প্রবেশ। একটি দোলনায় পিয়াল এপাশ-ওপাশ দোল খায়। মহীতুনের বেসুরো কিন্তু আন্তরিক ঘুমপাড়ানিয়া গানের সুর বাতাসের পাখায় করে বিস্তারিত হয়। দিন-মাস-বছর। আবু রইস ছুটে চলে চাখার-বরিশাল, বরিশাল-ঢাকা, ঢাকা-বরিশাল, বরিশাল-চাখার...।
বরিশাল শহর থেকে চাখারের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার। স্কুটারে আসা-যাওয়া। সেদিন বুধবার ছিল। আবু রইস বরিশাল থেকে চাখার ফিরছে। বেলা তখন ঝুলে পড়েছে পশ্চিমের একটা ডুমুরের ডালে। যে ডালে একটা কাক কা কা করে উড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ৬ জনের স্কুটারটা অত্যন্ত যন্ত্রণা কাতর শব্দে কাৎরাতে কাৎরাতে এগোয়। সামনের সেলুলয়েডের ওপারে সাপের মত লতানো রাস্তা। কখনও সোজা, কখনও বেঁকে গাছ-গাছালির ভিড়ে হারিয়ে যায়, আবার উঁকি দেয় খড়ের স্তুপের গা ঘেঁসে। দু’পাশে ছাড়া ছাড়া গাছ। উঁচু-নিচু, ঘন-পাতলা। রাস্তার দু’পাশে ১০-১২ ফুট নিচে জমির সরল বর্গাকৃতি রূপ। রাস্তা উঠতে থাকে একটা ব্রিজের দিকে। জমির সমতল স্তর থেকে রাস্তাটা ক্রমশঃ উপরে উঠতে থাকে। স্কুটারটা গিয়ার পরিবর্তন করলে পাচনের আগায় লোহার গুঁতো খাওয়া গরুর মত গো গো শব্দ করে। ব্রিজের উপর থেকে ক’টি গরু নিয়ে নেমে আসে ছেলেটি। ছেলেটি গরু সামাল দেয়। গরুগুলো এলোমেলো। ছেলেটা এদিক-ওদিক ছোটে। ছোটে গরুগুলোকে একত্রিত করতে। স্কুটারটা এগুচ্ছে এবং ছেলেটির মুখোমুখি হচ্ছে। ছেলেটি তখন রাস্তার মাঝখানে । স্কুটার সাইড নেয়। সামনের গরুটি তখন ছুটে আসে স্কুটারের মুখে। স্কুটারটার সামনের চাকা মোচড় খেয়ে কার্নিশে হেলে পড়ে। অতঃপর যা ঘটল তা অতীব সাধারণ। স্কুটারটা উল্টে পড়ছে। একবার। দু’বার। কয়েকবার। কখনও উল্টে কখনও আছড়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্কুটারটি জমিতে গিয়ে মৃতবৎ অবস্থান নেয়। মানুষগুলো কেউ ভেতরে, অর্ধেক বাইরে, কেউ সম্পূর্ণ বাইরে ছিটকে পড়ে, চিৎকার করে। আবু রইস জমিতে নিজেকে সনাক্ত করে এবং উঠতে চেষ্টা করে। সামান্য কাটাকাটিতে কিছুটা রক্তাক্ত অবস্থায় যতটুকু আহত হয়েছে তার চেয়ে অধিক গুরুত্ব পায় তার মেরুদন্ডের আঘাতটা। সে ঘাড়ের পেছনে কটমট করে একটা মৃদু আওয়াজ মনে করতে পারে এবং স্পষ্টতঃতই সে অনুভব করছে একটা ধীর লয়ে কিন্তু গভীর ব্যথা প্রথম ঘাড়ের মেরুদন্ডের অংশ অতঃপর সমস্ত পিঠ এবং সর্বোপরি সারাদেহ ছড়িয়ে পড়ে। আবু রইস ঝিমিয়ে আসে, গুটিয়ে আসে দিনে দিনে। মেরুদন্ডের ক’টি কশেরুকা বিচ্যুতি হয়ে করোটি স্নায়ুর কিছু তন্তু চেপে দিয়েছে ও কিছু ছিঁড়ে দিয়েছে। ফলে মটো আজ্ঞাবাহী নার্ভগুলো অকেজো হয়ে গেছে। এ ভাবেই একটা বিষ্ময় পরিণতি আবু রইসকে নিশ্চল ও অক্ষম অবস্থায় এনে দিয়েছে। তার চোখ থেকে, মন থেকে একটা শানানো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ধুকে ধুকে নিস্তেজ এবং মৃতবৎ হয়ে গেছে।
পাশের রুম থেকে মিশ্র শব্দ আসছে। পিয়ালের খাট ক্যাচক্যাচ করে নড়ে ওঠার শব্দ, তার ঘুম ভেঙ্গে হাই তোলার শব্দ, ট্র্যাক স্যুট ঝেড়ে নেয়ার শব্দ। পিয়াল উঠবে ঘড়িতে ৫টার ঘণ্টা পড়ার কিছুক্ষণ পর। সে উঠবে কিন্তু কখনও বাবা-মাকে ডাকবে না। পিয়াল নিজের মত করে চলে। কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এ স্তর সে অনেক আগেই পার হয়ে এসেছে। পাশের রুমে একজন সম্পূর্ণ অক্ষম অন্যজন অর্ধেক অক্ষম এ রকম দুটো মানুষের একটা অস্বাভাবিক জীবন-যাপনে সে কখনও হস্তক্ষেপ করতে রাজি নয়। নইলে পিয়াল যেদিন বুঝতে শিখেছে সেদিনই মাকে বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘মা তুমি বিয়ে কর’। একজনের উপর অন্যজনের ভালোবাসা মমত্ববোধ মানে এই নয় যে, একটা জীবনকে অগ্নিদগ্ধ হতে হবে। তার বাবার প্রতি তার মায়ের যে দায়িত্ব তা একজন বেতনভুক্ত কর্মচারীও করতে পারে। মৌসুমী তাকে কি জন্য ভালোবাসে? পিয়াল যখন ভোরে ঠিক ৪৫ মিনিট দৌড়ে মানিক মিয়া এভিন্যূতে পৌঁছে গুণে গুণে ২৫ টা বুকডন সেরে হাত ঝাড়ে, মৌসুমী তখন তার পাশে কেন এসে দাঁড়ায়? এটাই সেক্স। যা ভালোবাসার অন্যতম শর্ত। সেক্স বা যৌন ক্ষমতার স্পষ্টতাই একজনের প্রতি অপরজনের ভালোবাসাকে দৃঢ়তর করে। যা স্পষ্টতর হয় দৈহিকভাবে, মনোগতভাবে নয়। একজনের মন বোঝার জন্য মনে প্রবেশ করা প্রয়োজন, যা সময় সাপেক্ষ কিন্তু দৈহিকভাবে কাউকে পছন্দ করার জন্য প্রথম দর্শনই যথেষ্ট। তাই প্রথম দর্শনেই প্রেম বলতে যে কথাটি শ্রুত রয়েছে তা মোটেই মনোগত নয়, সম্পূর্ণভাবে দেহগত। মৌসুমী দেখেছে পিয়ালের একটা সোমত্ত ও পেশল দেহ। মৌসুমী যদি পিয়ালকে দেখে সেক্সকে গৌণ মনে করত তাহলে দেখা যেত সে ভালোবাসত না। তাই পিয়াল অনেক আগেই যে বিষয়টা চিন্তা করেছে একান্ত নিজের মত করে, তা অনেকটা এরকমĮ তার মা তার বাবা আবু রইসকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে সত্য কিন্তু যে কোন দৈব কারণেই হোক মাত্র ১ বছর ৭ মাসের ব্যবধানে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবার পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর সংসার থেকে যখন যৌথ যৌন সম্ভোগ চিরতরে নিঃশেষ হয়ে গেছে অথচ তার মার যৌন আকাক্সক্ষা তখন স্বাভাবিক ভাবেই তীব্রতর থাকার কথা তখন অত্যন্ত যৌক্তিক কারণে তার মার বিয়ে করা আবশ্যক ছিল। পিয়াল আরও চিন্তা করে দেখেছে দুর্ঘনাটি যদি তার বাবার না হয়ে তার মার হতো তখন নিশ্চয়ই তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতেন, শুধু তাই নয় এ দেশের কোমলমতি মায়েরাই তাদের স্বামীকে আবার বিয়ে করার জন্য তাড়িত করে থাকেন। মৌসুমীও তাই করবে এবং করা উচিৎ সে কথা পিয়াল তাকে বলেছেও। সেদিন একই কথার অভিপ্রকাশ করল ঠিক তার বাবার সামনে। মৌসুমীকে সেদিন হঠাৎ করেই খেয়ালের বসে বাবা-মাকে দেখাবে বলে সরাসরি বাসায় নিয়ে এসে বাবার পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দেয়। মৌসুমী বাবা-মা দু’জনকে সালাম করে অনেকটা সহজ ভঙ্গিতেই বসে রইল। মহীতুন মৌসুমীকে দোয়া করল এই বলে যে,‘মা, দোয়া করি তুমি আমার পিয়ালের জীবনকে সুন্দর করে তোলে।’ আর আবু রইস এভাবে দোয়া না করে প্রথমে মৌসুমী ফুটফুটে সুন্দর বলে প্রশংসা করলেন এবং পরে বললেনĮ‘তুমি আমার পিয়ালকে বেঁধে রাখতে পারবে তো?’ পিয়াল এটুকু আঁচ করতে পেরেছে যে তার বাবা অনেকটা দুষ্টুমি মেখেই মৌসুমীকে কথাগুলো বলেছে। কিন্তু অতঃপর পিয়াল যা বলেছে তা শুনে মহীতুন ছেলের স্পর্ধার পরিমাপ করতে না পেরে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল এবং আবু রইস মহীতুনের মত ছুটে যেতে পারল না কিন্তু তার নিজের মধ্যেই বেঁচে থাকার অনাগ্রহটা প্রচন্ডভাবে নড়ে উঠল। পিয়াল দাঁড়ালে এবং মৌসুমীর মুখের দিকে তাকালো একবার। তারপর বলল ঠিক এভাবে বাবা, আমি মৌসুমীকে বলে দিয়েছি, আমার বাবা দুঃখজনকভাবে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেছেন। মা, বাবার ভালোবাসার কথা ভেবে সারা জীবন বিয়ে না করে দেবী হয়ে আছেন। তুমি যেন কখনও অমনটি করে দেবী হতে যেও না। আমার যদি কখনও ওরকম কোন কারণে পঙ্গুত্ব লাভ করতে হয় তুমি অবশ্যই বিয়ে করবে। কারণ আমার ভেতরে এক আমার মৃত্যু ঘটবে কিন্তু তোমার ভেতর অন্য তুমি তখনও জীবিত। যদি অনুকম্পা বা ভালোবাসা দেখাতে হয় তখন বেতন দিয়ে একজনকে নিয়োগ করতে পারলেই চলবে। তখন তুমি কিংবা অন্য যে কেউ আমার কাছে এক। কিন্তু তোমার কাছে আমি ও অন্য পুরুষ এক নয়।”
দক্ষিণ পর্বঃ আবু রইস মৃত্যু কামনা করেন
অন্ধকারটা কেটে যায়নি তখনও। ঘরের এক কোণে টেবিল ল্যাম্পের হলদে ভারি কাপড়ের ভাঁজ সরিয়ে বেরিয়ে আসা ০৫ ভোল্ট এর এক ধরনের মায়াবী আলো সারা ঘরময় সমান ঘনত্বে ছড়িয়ে আছে। ঘুমের আলস্য ভাঙ্গেনি তখনও মহীতুনের। কেবল বেরনোর প্রস্তুতির শব্দ আসছে পিয়ালের ঘর থেকে। আবু রইসের ডান পাশ সংলগ্ন জানলাটা খোলা ছিল সারারাত। জানলাটি খোলা থাকার কারণেই রাতে মাঝে মধ্যে ইউক্যালিপটাস গাছটি ছুঁয়ে কিংবা গাছটিরই এক-ঝটকা, আধ-ঝটকা বাতাস হাঁটা-হাঁটি করেছে সারা ঘরে। যে বাতাস আবু রইসের গায়ে শিরশির হাত বুলিয়ে দিয়েছে, মহীতুনের গায়ে লুটোপুটি খেয়েছে। মহীতুন বাতাসে গা এলিয়েছে, সখ্য গড়েছে, অতঃপর ঝিমিয়ে পড়েছে। ইচ্ছে করলে মহীতুন তার একান্ত ব্যক্তি জীবনের চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে পারত। একদা ভালোবাসার একমাত্র মানুষ আবু রইসের এ অকাল পরিণতিতে তার ভালোবাসা অনেকগুণ বেড়ে গিয়ে জীবনের চাওয়া-পাওয়াকে যদিও অত্যন্ত লঘু মনে করত কিন্তু ধীরে ধীরে সে বিষয়টাই লঘু হয়ে গেছে। মহীতুন অন্যত্র সংসার সাজাতে পারত কিংবা মতিঝিলের এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার লিয়াকত সাহেবকেও খুশি করতে পারত। দেখতেও মন্দ ছিল না লিয়াকত সাহেব। সে দিন যেমনিভাবে লিয়াকত সাহেব ফাইল সই করতে যেয়ে মহীতুনের হাত চেপে ধরেছিল ক্ষীণ ইচ্ছা থাকলেও সে মিটিয়ে নিতে পারত। কিন্তু তখন আবু রইসের একটি ম্লান ও অসহায় মুখ তার সামনে এসে স্থির হয়। অন্য সময় বিশেষ করে ভোর রাতে দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং শব্দে মহীতুনের আপাদমস্তক ছুঁয়ে যায় তখন তার বোধ থেকে নীতি-নৈতিকভাবে বিলোপ হয়। তখন অবলীলায় এসে হাজির হয় এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার লিয়াকত সাহেব কিংবা এক দু’বার দেখা দু’চারটি মুখ। হয় না। কারণ আলোটা ফুটে উঠলেই তার আবু রইস অত্যন্ত বিনীত ভাবে পড়ে থাকে। আবু রইস ক্ষীণ, বিমর্ষ ও করুণ।
মহীতুনের দিকে তরলায়িত আবু রইসের দৃষ্টিটা আরও ঘন হয়ে উঠে। একটু ঘুম ঘুম ভাব তাকে কিছুটা আচ্ছন্ন করে রাখে। ঘুম আসে। ভাবনা চিন্তার লাগাম ধরে ঘুম আসে। ভাবনা চিন্তার লাগাম ধরে ঘুম এসে ভিড় করে, আবু রইসের দু’চোখে । আবু রইস চোখের পাতা টেনে ঘুমকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। আলো ও আঁধারের কেমন একটা মেশালো ভাব। অবচেতন অথচ সচেতনতায় সবকিছু ধরা পড়ে এমন এক ধরনের অবস্থায় আবু রইস জীবনের এক চরম দুঃখজনক ও অকল্পনীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে।
আবু রইস প্রত্যক্ষ করে জানালার ওপার থেকে ইউক্যালিপটাস গাছটি অত্যন্ত সন্তর্পনে ভেতরে প্রবেশ করে। গাছটি আজ আবু রইসের সাথে কোন কথা বলল না। এবং হাত মেলালো না। তবে মৃদু হাসলো। ইউক্যালিপটাসের এ হাসি গলে গলে ছড়িয়ে পড়ে আবু রইসের শরীরে, সারা ঘরময়, সর্বোপরি মহীতুনের অগোছালো শরীরে এবং তার ফিরোজা শাড়ির ফাঁকে-ফোঁকে। মহীতুন যেন এ স্পর্শ অনুভব করে এবং আমন্ত্রণ ইঙ্গিত করে। ইউক্যালিপটাস গাছটি মহীতুনের দিকে এগিয়ে যায়। আবু রইস স্পষ্টতই দেখে কিন্তু কোন মায়াবী পাথর চাপা পড়ে তার বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ইউক্যালিপটাস মহীতুনের পাশে বসে। একটি হাত বেরিয়ে আসা মহীতুনের হলুদ পা স্পর্শ করে। প্রথমে হাত অতঃপর চুমু খায় পায়ের পাতায়। মহীতুন প্রত্যাশিত স্পর্শে কেঁপে ওঠে। ইউক্যালিপটাস চুমু খায় উরুতে, পেটের মসৃন ত্বকে, চিবুকে, কপোলে, গ্রীবায় এবং ঠোঁটে। মহীতুন কিছুটা উন্মাতাল হয়। ইউক্যালিপটাস মহীতুনের অধরে চুমোয় আবিষ্ট হয়ে লুটিয়ে পড়ে বুকের উপর। মহীতুন চরম তৃপ্তির আভাস দেয় শব্দে। এদিকে আবু রইস মায়াবী পাথরের নিচে চাপা পড়ে বাকরুদ্ধতায় সারা শরীর ঘেমে উঠে। ইউক্যালিপটাস গাছটি যেন দীর্ঘদিনের বিশ^াসকে চূর্ণবিচূর্ণ করে আবু রইসের ঘরের সিন্ধুক ভেঙ্গে সবচেয়ে মূল্যবান ধন চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত কষ্টে মায়াবী পাথর সরিয়ে এক সময় আবু রইস চিৎকার করে ওঠে এবং বিড়বিড় করে বলতে থাকে আমি বাঁচতে চাই না। আমি মৃত্যু চাই, আমাকে মৃত্যু দাও..........।’
আবু রইসের চিৎকারে মহীতুন জেগে ওঠে এবং আবু রইসের বিছানায় বসে। পিয়াল আসে সামনের দরজা দিয়ে। মাধু এসে পায়ের কাছটায় বসে। সবাই চিন্তিত এবং উদগ্রীব হয়ে আবু রইসের চিৎকারের কারণ জানতে চায়। আবু রইস কোন কথা না বললে সবাই সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে কোন দুঃস্বপ্ন দেখে নিশ্চয়ই চিৎকার করেছে।
আবু রইস তখনও নির্বাক ও স্তব্ধ। তার দু’চোখ গলে গলে পানি উপচে পড়ছে। যে পানি নিজের অসাড় হাতে মুছে নিতে পারছে না। আবু রইস তারপরও হাত তুলে আনার চেষ্টা করলে মহীতুন আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। আবু রইসের দৃষ্টি তখন চোখের জলের ভেতর দিয়ে পরিস্রাবণ হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। যেখানে আবু রইস স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করছে চাখারের মনিপুর গ্রামের রাস্তা ধরে একটি খাটিয়ার ৪ পাশে ৪টি ইউক্যালিপটাস গাছ আবু রইসের লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
-কামরুল হুদা পথিক