এবাদত কলুর একটা-ই ঘর। অর্ধেকটায় আম কাঁঠের তক্তা বিছানো চৌকিতে তিন সদস্যের থাকা-খাওয়া আর বাকি অর্ধেকটায় চোখে আন্দুসী পড়া তার রোগা-পাতলা-ছালওঠা মাদি ঘোড়াটা এবাদত কলুসহ গাছের ভারি তক্তা টেনে টেনে একটি নির্দিষ্ট বৃত্তপথে ঘুরতে থাকে। বৃত্তের কেন্দ্রে মূল ঘানি, ঘানিতে বসানো ঝাইট, যা তেল তৈরির পেষণযন্ত্র সদৃশ এবং ঝাইটের সাথে বানদরার টান-সংযোগ নিয়ে ব্যাসার্ধ পথে অবস্থান করে আসন-তক্তা। যার উপর কোন ভারি পাথর কিংবা এবাদত কলু নিজেই আসন পেতে বসলে ঘোড়াটি তার নিজ কর্মে তৎপর হয় এবং তখনই ঘানি ও ঝাইটের মাঝপথে সর্ষের দানা পিষে ঝাঁঝালো গন্ধ নিয়ে সোনালি তেলের সরু নালা বেরিয়ে আসে নিচের ছিদ্রপথ দিয়ে। আর ভারি তক্তার তেল-চিটচিটে ধার ঘানির খাঁজপথে যখন ঘূর্ণন শুরু করে, তখন ক্যাৎ-ক্যা-ৎ-ক্যাৎ----কলুবাড়ির এ নিজস্ব ও পরিচিত সুর-শব্দ সারাবাড়ি, সামনের এক টুকরো উঠান এবং বড় সড়ক থেকে নেমে আসা লাতানো গোপাটের সবটুকু ভরে ওঠে।
এবাদত কলুর তিন পুরুষে কেউ বই-স্টেøটের কর্মটুকু করেনি। তিন পুরুষ আগে কিছু জমি-জিরাত ছিল, যা পরবর্তী সময় আর টিকে থাকেনি। ঐ কলুগাছটিকে কেন্দ্র করেই জীবন-যাপন এবং এবাদত কলু পর্যন্ত এগিয়ে আসা ও যুগপৎ নির্ভরশীলতা। এবাদত কলুর কর্ম শুরু হয় খালপাড়ের মসজিদের ফজরের আজান শুনে। সিথানে কুঁচকে থাকা আলিমুনের শরীরটা সরিয়ে মাদি ঘোড়াটার চোখে আন্দুসী পরিয়ে পাছায় একখান থাপ্পর মারলেই বুঝতে পারে তার কর্ম-প্রণালী। শুরু হয়ে যায় সর্ষের দানা পিষে নরপথে তেলের নালা তৈরির কাজ। আসন-তক্তার উপর এবাদত কলুর ঝিমুনিতেই ভোরের আলো ঢুকে পড়ে সারা ঘরময়। আলিমুন বিছানা গুঁটায়। মুরগীর ছানাগুলো খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিতে চায়। অতঃপর সকালে আড়ৎ- এ এবাদত কলুর খাঁটি সর্ষের তেল নিয়ে যাত্রা। তেল বিক্রি করে যা আয় তা দিয়েই আটা-চাল, তিত্পুঁটির ভাগ, বিচি বেগুনের হাট, শরীফ বিড়ি আর পান্না সাহার খোলা বিস্কুটের স্তুপ থেকে এক পোয়া। এবাদত কলুর একমাত্র ছেলে সান্টু একটি অবৈতনিক ইস্কুলে যাওয়া আসার বদৌলতে যতটুকু পুলক সঞ্চার করে, এ সংসারে তারই নজির যেন ইস্কুলে যাওয়ার পথে দুটো ও ফেরার পথে দুটো বিস্কুট সান্টুর হাতে তুলে দেয়ার এ মনোবাঞ্ছা।
আমরা যখন এবাদত কলুর বাড়ি পৌঁছালাম তখন থেকেই মনের গহীনে নতুন একটা চিত্রপট আবিষ্কারের অনুভূতি বিরাজমান। যে অনুভূতিটা শুরু হয়েছিল একটি আঞ্চলিক সাপ্তাহিকীতে এবাদত কলু সম্পর্কিত অদ্ভুত সংবাদটি গোচরিভূত হওয়ার পর। তৎপর আমাদের ভাতুড়িয়া যাত্রা এবং অনেকটা নতুন করে দেশকে দেখা। যানবাহন থেকে নেমে যে ২ ঘণ্টা ২০ মিনিটের হাঁটাপথ, তা পার হতে হতে সরু ও ভাঙ্গা পশ্চিমে গমের অস্থায়ী সড়কের দু’পাশে ফেলে আসতে হয়েছে ৮০ হাজার গ্রামেরই অনেকগুলো ভূখা-নাঙ্গ-গ্রাম। গ্রামগুলোর মধ্যে হঠাৎ শহর থেকে নেমে আসা টেম্পোর ভট্ভট্ শব্দ শুনে এক দল উলঙ্গ শিশুর পিছু ছুটার মত উন্মুখ আর হতবাক দাঁড়িয়ে থাকার চিহ্ন দৃশ্যমান। এবাদত কলুর বাড়ির সামনে এসে বড় রাস্তা থেকে নেমে আসা সড়কটি পা’হাটা গোপাটে পরিণত হয়ে গেছে। অদ্ভূত এবং একেবারেই নতুন কলুগাছের ক্যাৎ------ক্যাৎ-----ক্যাৎৎ---ৎ--- শব্দটিই শেষবধি আমাদেরকে এবাদত কলুর বাড়ি সনাক্ত করতে সহযোগিতা করেছে।
একটা ঝাঁকড়া ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শ্যাওড়া গাছের ডাল ধরে আমরা এবাদত কলুর উঁচু মত বাড়িতে উঠলাম। যে একফালি উঠান তার পশ্চিম পাশের্^ বহু দিনের পুরনো একটি ঘর থেকেই অদ্ভুত শব্দটি ভেসে আসছিল। পূর্বপাশে দুটি খুঁটি আর মাটির বিরাটকায় গামলায় ভাতের মাড়ের চিহ্ন দেখে ঘোড়ার জন্য নির্ধারিত জায়গাটি অনুমেয়। বেশ পুরনো গোটা তিন আম গাছ এবং ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটা মৃত জলপাই গাছ বেলা শেষের ছায়া ফেলেছে সারা উঠান জুড়ে, আর অনেকটা আধ ছায়াতে একটা মাদুর পেতে শুয়ে আছে এক অশীতিপর বৃদ্ধ। কিছু লোক এসে মাঝে মধ্যে বৃদ্ধ লোকটির পাশে বসছে এবং যে ক’টি বাক্য প্রায় সবাই ব্যয় করছে তা অনেকটা এরকম- ধর না দ্যাশের সরকার হইল গিয়া একখানা বড়সড় ব্যাপার। হ্যারে লাগাল পাওয়ন তোমার আমার সদ্ভাব না। এ কথাটা তুমি বুঝবার পার না ক্যান? বুইঝা না বুইঝা হেই যে তুমি পাগলামিডা শুরু করলা তাতো তোমার নিজেরই ক্ষতি। আমাগো যা কাম, তা দিয়া যা আয় হয় তা দিয়াই সংসার চালাইতে হইব। তুমি তোমার জিদ ছাইড়া দেও। এবাদত কলু নিস্তব্ধ। তার তাকানোর ভঙ্গি অনেকটা ভয়ংকর। আড়াআড়ি কোন দৃশ্যবস্তুর ওপর তীরের ফলার মত ছুঁড়ে পড়ছে। সম্ভবত এবাদত কলুর বউ হবে, আমাদের ক’জন শহুরে মানুষের আগমন আঁচ করতে পেরে একটু লুকিয়ে গিয়েছে। তবে তার পায়ের নিচের ভিত্তিটার এ তথৈবচ দশা এবং ভবিষ্যৎ জীবদ্দশার চিন্তায় ভাঙ্গাচোরা মুখাবয়ব যেন আমাদের চারপাশে দৃশ্যমান হয়েই অবস্থান করে।
আমরা এবাদত কলু এবং এ সম্পর্কিত বিষয়াদির প্রাথমিক মূলো˜্ঘাটনের কালটায়- ই ভাতুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শহীদুল আলম নামক এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় ঘটে যায়। তিনি যখন শুনলেন এবাদত কলু সম্পর্কে আমাদের অবগতি, অতঃপর তার বর্তমান অবস্থা- প্রশাসন এমন কি সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যেই আমাদের এখানে আসা, তখন তার চোখে এক ধরনের কৃতজ্ঞতার দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছিল। সে সুবাদেই শহীদুল আলমের বাড়িতে আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। অতঃপর আমাদের ভাতুড়িয়ায় তিনদিন অবস্থান, পর্যবেক্ষণ, বিবিধ আলাপ, অভিজ্ঞতা, অসম্ভব ও তীক্ষ্ম এক মেধার আবিষ্কার এবং আমাদের ফিরে আসা। এ সমগ্র ঘটনার ক্রম দৃশ্যপট নিন্মের তিনটি পর্যায়ে সাজানো।
দৃশ্যপট-১
শহীদুল আলমের বাড়ি। বাইরের উঠানে তিনটি চেয়ারে আমি, কায়েস এবং শহীদুল আলম। শহীদুল আলমের নির্দেশে মাঝারী বয়সের একজন লোক, সম্ভবতঃ নিকট সম্পর্কীয় কেউ হবে, কলকের লাল কয়লায় ফুঁ দিতে দিতে হুকো নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাস্টার সাহেব অবশ্য ইতিমধ্যে ভাতুড়িয়া বাজার থেকে ফিল্টার সিগারেট আনিয়েছেন আমাদের জন্য। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে তা আবার আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
মাস্টারঃ ধরেন, সিগ্রেট ধরেন। ভাতুড়িয়া বাজারে এর চাইতে ভাল সিগ্রেট নাই। আমাগো জন্য হইল হুক্কা। যতই দামের সিগ্রেট দেন না কেন আমাগো চলব না। বাপ দাদার হুক্কায় টান না দিলে তেষ্টাটা মিটে না।
কায়েসঃ আচ্ছা, এবাদত কলুরতো একটা-ই ছেলে, তাই না?
মাস্টারঃ জি, একটা-ই কায়েসঃ জি, একটা-ই
কায়েসঃ কি যেন নাম?
মাস্টারঃ সান্টু কায়েস ঃ সান্টু কি আপনার স্কুলে পড়ে?
মাস্টারঃ জি, আমার ইস্কুলেই পড়ে। বছর তিন হইব, একদিন আমি নিজেই কইলাম, এবাদত শুন, আমারও বাপ-দাদা কিন্তু লেখাপড়া করে নাই। আমি লেখাপড়া করছি। আর লেখাপড়া করছি বলেই তোমরা আমাকে মাস্টার কইয়া ডাক। সম্মান কর। তোমার সান্টুরে আমার ইস্কুলে পাঠাইয়া দাও। একটু আধটু কাজ কামে তোমার অসুবিধা হইব, তারপরও তোমার সান্টু পড়ালেখা শিখুক।
কায়েসঃ হবে না। সান্টুর একদিন ইচ্ছে থাকলেও পড়াশুনা হবে না। সান্টু যতদিন উপার্জনে পুরোপুরি সক্ষম না হবে ততদিনই স্কুল, পড়াশুনা। তারপর তার বাবার কলুর ঘানিতেই তাকে ফিরে আসতে হবে। এটাই এ মুহূর্তে স্বাভাবিক। এখনইতো মাঝে মধ্যে তাকে ঘানিতে বসতে হয়, না কি বলেন মাস্টার সাহেব?
মাস্টারঃ তা ঠিকই বলেছেন।
মাস্টার ও কায়েসের আলোচনা ক্রমশঃ গভীরতম হতে থাকে। আমি এ আলাপচারিতায় অংশগ্রহণ করলাম না। দীর্ঘক্ষণ চাঁদ ছড়ানো উঠানে মাস্টারের কলকে থেকে উত্থিত এবং পাকানো ধোঁয়ার দিকে চোখ নিবন্ধ করে রাখলাম। অনেকগুলো ঘন টান দিয়ে ধুঁয়োর কু-লী ছেড়ে দিলে ফরসা চাঁদের আলো যে ভাবে অস্বচ্ছ ঘোলা হয়ে যায় তেমনি অস্বচ্ছ ঠেকছে এই ভাতুড়িয়া গ্রাম, তার জনপদ, কিংবা তার জীবন প্রক্রিয়া। এবাদত কলুর উচুঁমত উঠোনে দাঁড়ালে সবুজ ধানি জমি, ঘন সর্ষের হলুদ মাঠ, আর আধ-হাঁটু থেকে কোমর-জল পার হয়ে দূরে লতানো ঘন সবুজ গ্রাম, তার ভেতর থেকে যে চিত্রের পরিস্ফুটন ঘটে সেখানেই বড় রকম বিবেধ। গভীর রাতে ভাতুড়িয়ার মানুষ স্বপ্নপুরীর ভৌতিক শব্দের মত রেলের সাইরেন শুনে। বিশেষ করে অন্ধকার রাতে এবাদত কলুর উঠান থেকে যে দুটো বিষয় ভাতুড়িয়া বাসীদের আগ্রহী করে তুলে তা হল আশুগঞ্জ সার কারখানার আলোঝলমল দৃশ্য এবং অপরটি জেলা সদরে তিতাস গ্যাসের জ¦লতে থাকা অগ্নি শিখায় লালাভ আকাশ।
ভাতুড়িয়ায় এখনও বিদ্যুতের খুঁটি পড়েনি। এখানে কখনও রিক্সার ঘণ্টা বাজে না। নিন্ম মাত্রার উৎপাদনক্ষম কৃষি জমিতে লাঙল চালিয়ে এক ধরনের মৃতবৎ বেঁচে থাকার কর্মপ্রণালী চলমান। এবাদত কলুর সে কর্মটুকুও নেই। যেটুকু তেল নিয়ে এবাদত কলু আড়ৎ-এ যায় তার বিক্রিত অর্থের ওপরই তার বেঁচে বর্তে থাকা। যেদিন বিক্রিত অর্থ চাহিদা পূরণে অসমর্থ হয়ে পড়ে সেদিনের আড়ৎ-ফেরৎ এবাদত কলু অন্য রকম মেজাজে গুম হয়ে থাকে। এ দৃশ্য আলিমুনের অচেনা নয় বলে সে কখনো কোন প্রকার ইতি-উতি করে না। গত ১২ বছর ধরে তাদের ঘানি টানার এক মাত্র মাদি ঘোড়াটি যে বেশ আগেই কর্ম অনুপযোগী হয়ে গেছে তা দু’জনেরই জানা। দীর্ঘদিন ধরে এবাদত কলু ঘানির ঘুরাতে ঘুরাতে আলিমুনের সাথে তাদের থাকার জন্য আলাদা একটা ছাওনি চাই- এই ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে।
শেষরাত থেকেই যে ঘানিকর্মের শুরু, মাঝপথে হয়ত হঠাৎ করেই ঘোড়ার মল-মূত্র ত্যাগ কিংবা ঘানির ছড়িয়ে পড়া শব্দ, অন্তত এসবের সাথে ঘুম-বিশ্রামের সহাবস্থান চলে না- এবাদত কলু এটুকু বোঝে। এটুকু বুঝতে পেরেও এক যুগে তার আলাদা ঘর হয়নি। হয়ত এমনও হতে পারে এবাদত কলুর বাবা সালমান কলু কিংবা তারও বাবা জেতন কলুও এ দু’মুখো কর্মের সহাবস্থানের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও আলাদা করতে পারেনি। চার পুরুষের যে ঐ একটাই ঘর তার প্রমাণ মিলে এবাদত কলুর ঘরের মাঝ তীরে কাঁচা হাতের কাঠখোদাই লেখাটি থেকে ‘১৩ই চৈত্র ১২৮০ বাংলা’। এবাদত কলুর সময় এসে উত্তরের চাল খুইয়ে শনের ছাউনি এবং দক্ষিণের অর্ধেক বেড়া পাটখড়ির বেড়ায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রতিনিয়তই যেন জোড়াতালি চলে সব দিকে। কোনভাবেই এগোনোর আভাস মিলে না। বৈচিত্র্যহীন এবং কঠিন বাস্তবতার ভর করে এবাদত কলুর জীবনে ক্লান্তি চলে এসেছে। শুধু এবাদত কলু কেন? মাদি ঘোড়াটাও কি আর আগের মত ছুটে চলে? চলে না। যেদিন প্রথম ভোলাচং বাজার থেকে ঘোড়াটি কিনে এনে চোখে আন্দুসী পরিয়ে দেয়া হয়েছিল, সে দিন যে উদ্যমে ও তেজে এবাদত কলু ও তার কোলে সান্টুকে নিয়ে ভারি তক্তা টেনে ছুটছিল আজ যেন তা পারছে না। ক’পাক ঘুরেই পা ভেঙ্গে বসে পড়তে চায়, এদিক ওদিক ছুটতে চায়, গামলার ফেনে মুখ চুবিয়ে প্রশান্তি পেতে চায়। প্রাণীদেরও তো জীবনবোধ আছে, আছে নি¤œতম চাহিদা, দাবী- দাওয়া। প্রকাশ ভঙ্গিটা ভিন্ন, তাই আমাদের অচেনা। এবাদত কলু মাঝে-মধ্যে আদিখ্যেতা দেখিয়ে আলিমুনকে বলে-দেখছস বউ, ঘোড়াডা আর আগের মতন চলে না। ক্যান চলে না তা আমি বুঝি। এই যে একখান ভারী তক্তা টাইন্যা নেওয়ন, এর ল্যাইগা তারওতো খাওয়ন চাই। ভাতের ফ্যানের লগে খৈল-ভূষি চাই, আসমানের নিচে একখান ছাওনি চাই। আমি তো তারে এসব দিতে পারি না। পারি না বইল্যা আমার কুনো কষ্টও নাই। কারণ আমি কি নিজেই খাইতে পাই তি বেলা? আমার নিজেরই কি আলাদা একখান ছাওনি আছে থাকনের? খৈল, তেল আর ঘোড়ার চনার আঁইশটা গন্ধের লগেইতো পইড়া থাকি। ভাবতাছি সান্টুরে ইস্কুলে দিয়া কি হইব? ঘানি চালানডা শিখন দরকার।
দৃশ্যপট-২
আমার আন্ধাইর ঘরের মানিক ঘোড়া আন্দুস পইরা কলুর ঘানি ক্যাতর ক্যাতর টানে রে মহাজনের দেনা দিনে দিনে বাড়ে রে। কলুর ঘানির ক্যাৎ-ক্যাৎ----ৎ----ক্য----।----ৎ শব্দের সাথে লয় মিলিয়েই এবাদত কলু গাইতে থাকে গীতটি। কোন সময় গুন্গুন্ করে আবার কোন সময় ভরাট কণ্ঠে দুই লাইন স্পষ্ট আবার হঠাৎ থেমে হয়ত ঘোড়ার পিঠে চাপড় মারছে দ্রুত হাঁটার জন্য। এবাদত কলুর বাবা যখন বার্ধক্যের কারণে আর তক্তার উপর উঠে বসতে পারত না কিংবা তক্তার ওপর ভারী পাথর বসিয়ে পিছু পিছু ছুটতে পারত না তখনও রোদে পিঠ ঠেকিয়ে এ গীতটি গাইত। আজ যেমনি সান্টু তার বাবার মুখে শুনতে শুনতেই শেখা। কলুর ঘানির শব্দের লয়ের সাথে যখন গীতটিও ওটা-নামা করে তখন এ গীতটি পাথরচাপা এক ধরনের গোঙ্গানীর মতই মনে হয়। ভাতুড়িয়া বাজারে ঈশান হোমিও হলের ডাক্তার চিত্তরঞ্জন বাবু হুকোর নলে টান মেরে এবাদত কলুর গীত বুঝতে চেষ্টা করে। ঘানির খাঁজে ঘুরতে ঘুরতে তক্তাটি বাবুর সামনে দিয়ে অতিক্রমকালে যে এক অথবা দেড় লাইন গাওয়া হয় সে টুকু বুঝতে বুঝতেই এবাদত কলু তার গীতকে উল্টোদিকে টেনে নিলে আবার খেই হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। চিত্তবাবু মনোযোগ সংযোগ করে এবাদত কলুর বুঁজো চোখ গীত গাওয়ায় দরদের মাত্রা উপলদ্ধি করতে চেষ্টা করে। ভাতুড়িয়া বাজার সন্ধ্যা গ্রাস করতে করতে টিমটিমে তেলবাতিগুলো যতটুকু আলো প্রদানে সক্ষম তাতে লোক সমাগম খুব শীঘ্রই আগ্রহ হারিয়ে ফেরৎ যাত্রায় তৎপর হয়। কিন্তু ঈশান হোমিও হলের আড্ডাটা টিকে থাকে তখনও। যে আগ্রহের আলোচ্য খোদ ভাতুড়িয়ার কৃষি ও কৃষক এ আলোচনায় সূচীবদ্ধ। এ আড্ডাটির কেন্দ্রীয় মুখ হচ্ছেন চিত্তরঞ্জন বাবু। যিনি এক সময় তুখোর বাম রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। এখন সক্রিয়তা হারালেও বিশ্বাসে অটল। দৈনিক পত্রিকা যেটি একদিন পর এসে ভাতুড়িয়া বাজারে পৌঁছে এবং তার ফোর ব্যা-ের রেডিওটা যতগুলো সংবাদ প্রচার করে সবগুলো শুনে শুনেই তার সমসাময়িক ও আধুনিকায়ন চর্চা চলমান থাকে। ফলে যখনই চিত্তবাবু আলাপে অংশ গ্রহণ করেন তখনই শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশ্লেষণ। আসরের ব্যক্তিটি শিক্ষিত কিংবা নিরক্ষর হোক, কৃষক কিংবা শ্রমিক হোক, কিশোর কিংবা বৃদ্ধ হোক আলাপের বিষয় বস্তু ঐ একটাই। সেদিন সালেহা নামে এক মহিলা যখন তার তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে এল সম্ভব কৃমির চিকিৎসা করাতে, চিত্তবাবু বলে বসলেন আচ্ছা তুমি কি মাদার তেরেসাকে চেন? মহিলার হতবাক দৃষ্টির প্রতি তাকিয়ে চিত্তবাবু যেন আরও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন তুমিতো অং সাং সুকীকেও চেন না বোধ করি। তারপর নির্ধারিত শ্রোতাকে উদ্দেশ্য করে চলমান থাকে তার আলোচনার গভীরতা। চিত্তরঞ্জন বাবুর খাঁটি সরিষার তেলের প্রতি অতি মাত্রার আগ্রহ থেকেই এবাদত কলুর সান্নিধ্য লাভের সূত্রপাত। মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি নির্ধারিত দিন, যেদিন চিত্তবাবু ৫ সের সরিষার ব্যাগ নিয়ে প্রায় ২১২ ঘণ্টা স্থায়ী অবস্থানের পুরোপুরি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এবাদত কলুর বাড়ি আসে। এবাদত কলু চিত্তরঞ্জন বাবুর আগমনকে তার অনেকগুলো সৌভাগ্যের একটি ভেবে পেীঁছামাত্রই প্রথমে উঠানে মাদুর পেতে বসতে বলে আলিমুনের উদ্দেশ্যে হাঁক দেয়- গেলি কই? শুনছস না- ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে- ডাক্তার বাবু, আইজ যাওনের সময় সান্টুডারে একটু দেইখা যাইবেন। পোলাডার শইলডা দিন দিন কেমুন যেন হইয়া যাইতাছে। এসব আলাপচারিতার ফাঁকেই ঝাইট, বানদরা, আসন-তক্তা সব ঠিকঠাক করে ঘানিতে সর্ষে ফেলে। অতঃপর আন্দুসী পড়া মাদি ঘোড়ার পিঠে চাপড় মেরে তক্তায় ওঠে বসে নিজে। এবাদত কলু যখন নিজের থেকে কথাবার্তা শেষ করে পুরনো গীতে মনোনিবেশ করে তখনই হুকোর টান ছেড়ে ঐ গীতের মর্ম উদ্ধারের চেষ্টা করে চিত্তবাবু। চিত্তবাবুঃ এ গীত কি তুমি নিজেই বানিয়েছো? এবাদতঃ জে না বাবু। আমি শিখছি আমার বাজানোর কাছ থ্যাইকা। আমার বাজান শিখছিল তারও বাজানের কাছ থ্যাইকা। চিত্তবাবুঃ তোমার ছেলেও কি শিখেছে? এবাদতঃ জে বাবু। পারে। ডাকুম? শুনবেন? চিত্তবাবু সম্মতি দিলে সান্টু এসে এবাদত কলুর পিছনে পিছনে হাঁটে এবং দু’জন এক সাথে গীত শুরু করে- আমার আন্ধাইব ঘরের মানিক জোড়া আন্দুস পইরা কলুর ঘানি ক্যাতর ক্যাতর টানেরে মহাজনের দেনা দিনে দিনে বাড়ে রে। একবার এবং বার বার। ধীর এবং দ্রুতলয়ে। কখনও ষ্পষ্ট কখনও অষ্পষ্ট। চিত্তবাবু নিশ্চুপ, কিছুক্ষণ শুনে, অতঃপর বাজার আমি যাই সান্টু প্রস্তান করলে এবাদত কলুর উদ্দেশ্যে চিত্তবাবু বলে- আচ্ছা এবাদত, তুমি কি আ-ার গ্রাউ- পলিটিক্যাল পার্টি মানে গোপন রাজনৈতিক দলের কথা শুনেছো? এবাদত কলু নিশ্চুপ কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করে। আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্যাল পার্টি যারা করে তারা বেশ ডেডিকেটেড হয়, বুঝলে? বুঝলে না? শোন, কখনও কখনও কোন কোন রাজনৈতিক দলের কর্মকা- সরকার নিজের জন্য ক্ষতিকর মনে হলে তখন সরকার ঐ দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু ঐ দলটি যদি তখনও গোপনে তাদের রাজনৈতিক কর্মকা- যায় তখন তাকে আ-ার গ্রাউ- পলিটিক্যাল পার্টি বলে। এবাদত নীরব। চিত্ত বাবুঃ ওরকম একটা আ-ার গ্রাই- দলের কর্মী ছিলাম আমি। তখ মনে কর দেহে ও মনে তেজ ছিল। সরকারের গোয়ারতুমি দেখে মনে হত বুকে তাজা বোমা নিয়ে সরকারের গাড়ির নিচে শুয়ে পড়ি। মরে যাওয়ার প্রতি বিন্দুমাত্র ভীতি ছিল না। কত বন্ধুইতো প্রাণ দিল এভাবে। শ্রীলঙ্কার এল,টি,টি, ই হচ্ছে অমন একটি দল। দেখলে তো পহেলা মে, যেদিন আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা ন্যায্য শ্রম ঘণ্টার দতাবিতে রক্ত দিয়েছিল ১৯৯৩ এর একই দিনে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানা সিংগে প্রেমাদাসাকে নিশ্চিহ্ন করে দিল চৌদ্দ বংসরের এক বালক অথবা রাজীব গান্ধীকে দেখ, একজন মহিলা ফুলের মালা পড়িয়ে দেয়ার কৌশলে ছিন্ন ভিন্ন করে দিল। এই হচ্ছে জেদ, বুঝলে জেদ, ডেডিকেশন। এবাদত নীরব এবং অধিক মনযোগী। চিত্ত বাবুঃ চিনের তিয়েন আন মার স্কোয়ারের নাম শুনেছ কি? এবাদত নীরব চিত্তবাবুঃ ঐ দেশের ছাত্ররা গণতন্ত্রের দাবাীতে তিয়েন আন মার স্কোয়ারে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ করতে চাইলে সরকার গুলি চালিয়ে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশেও কি ওরকম হচ্ছে না? তুমি আমি ভোট দিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট বানিয়েছি, প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছি, তোমার কিছু হলো কি? হয়নি। এবাদতঃ ক্যান, লাভ হয় নাই ক্যান? চিত্তবাবুঃ আচ্ছা, তোমার কথাই ধর। তোমার ঘোড়াটা দেখ সারাজীবন মূল ঘানির ৪ ফিট দূর দিয়ে ঘুরছে। তুমি তার মতই ঘুরছ। কখনও এক সাখে, কখনও পিছু পিছু। অথচ ঘোড়াটার জন্য কি তুমি আলাতা একটা ছাউনি বানাতে পেরেছো? পারনি। আচ্ছা তোমার ঘরটির কথাই ধর। তোমার দাদার ঘর। তোমার বাবা একটি চাল খুইয়ে গেছে। আর তুমি খুইয়েছ একটি বেড়া। কিন্তু দেশে কি সবাই তোমার মত রয়ে গেছে। তুমি হারাচ্ছ মানে অন্য কেউ পাচ্ছে। তোমার যাকে ভোট দিয়েছো তারাতো অনেকে সিঁড়ি টপকে টপকে অনেক ওপরে উঠে গেছে। অথচ তোমরা আমরা কেঁচোর মত গর্তেই পড়ে থাকি। কোন প্রতিবাদ করি না। করতে পারি না, এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল, অন্ততঃ সরকারের টনক নড়ে উঠত। এবাদত কলুর কান খাড়া হয়ে ওঠে। মনোযোগ আরও তীক্ষ্ম হয়। চিত্তবাবু তার ভাবনাগুলো যখন এবাদত কলুর ভেতর দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে, তখন এবাদত কলুর জং-ধরা মস্তিস্কের কোষে কোষে জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, এবং সচেতনতার বিভিন্ন অংকুরোদগম শুরু হয়।
এবাদত কলুর মস্কিস্কে একটা তাড়না ওম্ পায়। তক্তার ওপর বসে থাকা এবং মূল ঘানিকে কেন্দ্র করে চোখে আন্দুসী পড়া তার রোগা-পাতলা ঘোড়ার বৃত্তপথে ঘুরে আসা চাকার মত অনুভূতিটা ভূমি- সমান্তরাল থেকে উল্লম্ব বা খাড়া রূপ নেয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার চোখের সামনে চারটি মৃত্যুচিত্র ফুটে ওঠে। পুরো চাকার খাঁজগুলোর চারটিতে যথাক্রমে তার দাদা, বাবা, সে এবং তার ছেলে সান্টু অবস্থান নেয় এবং কর্মপ্রণালীতে চাকাটি ওপর থেকে নিচে ঘূর্ণন শুরু করতে পালাক্রমে সবাই চাকার নিচে চেপ্টে, থেঁথলে একাকার হয়ে যেতে থাকে। রক্ত, মগজ এবং মাংস মোচড়ানো, থেঁতলানো এবং দলানো অবস্থায় ভেতর ও বাইরে ছিট্কে পড়া এবং শুকিয়ে যাওয়ার যুগপৎ ছায়াচিত্র এবাদত কলুর কর্মস্পৃহাকে ক্রমশঃ থিতিয়ে তোলে।
এ দূরবস্থা থেকে পরিত্রানের একটাই উপায়। চাকাটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে দূর থেকে। যার জন্য চাই সরকারী উদ্যোগ। এবাদত কলুর চিন্তা-চেতনায় চিত্তবাবু যে ধারণাটি গেঁথে দিয়েছে তা হচ্ছে প্রতিটি মানুষের জীবন-যাত্রার উন্নয়নের মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়ন চিহ্নিত হয়ে থাকে। সরকার প্রতিনিয়তই দেশের উন্নয়ন কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। এবাদত কলুর কাছে এ কাজের চিহ্ন হিসেবে জেলা সদর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের হুইসেল, আশুগঞ্জের আলোঝলমল দৃশ্য কিংবা ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরে জ¦লতে থাকা তিতাস গ্যাসের জ¦লন্ত শিখায় ফরসা আকাশ ধরা পড়ে। এগুলো সে এক সময় দেখেনি, অথচ এখন দেখে। কিন্তু তার কী হল? কিছুই হল না। আসন-তক্তা টেনে টেনে যেমনি তার ঘোড়াটা একবিন্দু আগাতে পারেনি বরং পিছিয়ে গোছে। তার চোখে চার পুরুষের কর্ম, অবস্থান ও পরিণতির মধ্যে সাযুজ্যতা। কিন্তু কেন? সেওতো অনেকবার ভোট দিয়েছে এবং দেশের সরকার নির্বাচন করেছে । তার জন্য তো সরকার কিছুই করেনি। অথচ এটুকু করাতো সরকারের দায়িত্ব। চিত্ত বাবু যে বললেন গণতন্ত্রের জন্য চীনের তিয়েনআনমার স্কোয়ারে ছাত্ররা বিক্ষোভ করেছে, কারখানার শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনার জন্য হরতাল করেছে এবং অনশন করেছেম তাহলে এবাদত কলুও প্রতিবাদ স্বরূপ অনশন করবে। সে খাবে না, ঘরে যাবে না, খোলা আকাশের নিচে শুয়ে থাকবে এবং মরে যাবে। মরে তো একদিন যেতেই হবে। যে চাকাটা এবাদত কলুর চোখের সামনে খুব ধীর লয়ে ঘুরছে তার মধ্যে শুকনো আধ-শুকনো রক্তের দাগ। এবাদত যেন সে চাকারই নিচে থেঁতলে যাবার জন্য ক্রমশঃ সন্নিকট হচ্ছে। কলুবাড়ির কলুরা, কারখানার শ্রমিকরা, কৃষকরা, রিকসার চালকরা কিংবা ঠেলাচালক সবাই একই ভাবে জীবনের চাকা ঠেলে ঠেলে একদিন ঐ চাকার নিচেই মরে পড়ে থাকছে, পরে গলে শুকিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই দিনে দিনে এবাদত কলুর চিন্তাটা নিজের থেকে সরে সমাজের, দেশের অন্যসব মানুষের জীবন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
দৃশ্যপট-৩
আমরা এবাদত কলুর সাথে কথা-বার্তা বলার আগে পুরো ভাতুড়িয়া গ্রামকে বিবেচনায় আনি। ভাতুড়িয়া গ্রাম, সকালের আড়ৎ, সপ্তাহের হাট, এবাদত কলুর পাশাপাশি বাড়ি-ঘর এমন কি প্রতিদিন এবাদত কলুর এ দুরবস্থা শুনে যারা অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে ভিড় জমাচ্ছে তাদের সবাইকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা চলে, কথা-বার্তা চলে, পর্যবেক্ষণ চলে। ভাতুড়িয়া গ্রামে ১০৯৩ টি পরিবার। লোকসংখ্যা ৬ হাজার ৮ শত ৯২। ২০% লোক অবস্থা-সম্পন্ন। ৪০% লোকের থাকা ও খাওয়া একসাথে দুটোর ব্যবস্থা নেই। ঘানি সংশ্লিষ্ট জীবন যাপন করে ২০টি পরিবার। অন্যের কাজ করে জীবন নির্বাহ করে ১০%, মৎস্য চাষ ও বিক্রি করে জীবন চালায় ২৭ টি পরিবার এবং কম করে হলেও ২৮টি পরিবার ভিক্ষা করে। এবাদত কলুর অনশন অবস্থার ৫ দিন অতিক্রম হয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ লোকই তার অবস্থাকে মস্কিষ্ক বিকৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার একটা জোড় চেষ্টা চালালেও আমাদের কাছে ইতিমধ্যে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমরা এসে অনেক কষ্টে তাকে পানি বা তরল খাদ্য খাওয়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে এসব প্রচেষ্টার প্রতি মারাত্মক রকম বিরক্তি প্রকাশ করেছে। এবাদত কলুর দুর্বল শরীর এ ক’দিনে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এখন সে তেমন কথা বলতে পারে না। এবাদত কলুর এ অস্বাভাবিক কর্মকা-ের কারণে গ্রামের কেউ আর তার ঘানিতে সর্ষে নিয়ে আসে না। ফলে তার বউ হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে। আর ক’দিন এভাবে গেলে তাকে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিতে হবে---এই ভেবে আমাদের সামনে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বিষয়টি অনেকের কাছে উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অনেকে আবার এ বিষয়টি নিয়ে হাস্যপ্রদ কৌতুক সৃষ্টি করেছে। ভাতুড়িয়ার অন্য সব মানুষ বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে তা জানার জন্য আমরা একটি সাক্ষাৎকার নিতে নেমে পড়ি- আচ্ছা আপনি তো একজন ঘানির মালিক। এবাদত কলুকে আপনি একই-পেশার বলে ভাল জানবেন। বর্তমানে এবাদত কলু যে কাজটি করছে সে সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
জনৈক কলুঃ ধরেন না, দ্যাশেতো অনেক ধরনের পাগল দেখা যায়। আমরা সব নমুনা দেখি নাই। কিছু নমুনা দেখি। এবাদত কলুর যে পাগলামিটা এটা হইল গিয়া দিয়া ধরেন, দেখবেন শয়তানের বাপ কোন দিক দিয়া পালাইছে। আপনার নাম কি? জনৈক লোকঃ কিছমত। কি করেন? জনৈক লোকঃ কৃষি কাজ করি। আপনার বাড়িতো এবাদত কলুর বাড়ির পাশে জনৈক লোকঃ জে আচ্ছা আপনি কি জানেন এবাদত কলুর এ অবস্থা হল কেন? জনৈক লোকঃ আমি দেইখ্যা আইতাছি আজ ৪০ বছর ধইরা এবাদত কলু ঘানি টানতাছে। ভাতুড়িয়ায় সক্কালের আড়ৎ-এ তেল বেইচ্যা সংসার চালায়। ক্যান যে এরকম একটা কাম শুরু করল ইবাদত, বুঝাবার পারি না। ভয় অনুমান করি নিজে কাম না কইরা বউ-এর উপর বইসা বইসা খাওনের মতলব থাকতে পারে। --------------------------------------------------- একজন মহিলাঃ লজ্জায় কথা বলতে পারে না। আঁচল টেনে মুখ ঢেকে বলে, আমি কিচ্ছু কইতে পারুম না।--------------------------------------একজন লোকঃ আর যাই কন। এবাদত কলুর চালখান মন্দ না। এলাকার মানুষ প্রতি দিন ভাইঙ্গা পড়তাছে দ্যাখনের লাইগ্যা। এই যে এত লোক আসে, দেখে, কথা কয়, খাওয়ন দিতে চায়, এডাওতো মন্দ না। যেমন আপনেরা ঢাকা থ্যাইকা আইলেন। এডাও কম কি? একটি জাতীয় পত্রিকার সংবাদ এবাদত কলুর অনশন ও প্রধানমন্ত্রীর দর্শনপ্রার্থী এপ্রিল ১০, ১৯৯৩। ব্রাক্ষণবাড়ীয়া। ভাতুড়িয়া গ্রামের এবাদত কলু ঘানিতে সর্ষে পিষে জীবন নির্বাহ করে। পৃষ্ঠা ৬৬ থেকে শুরু করতে হবে।
এবাদত কলু অনশন কাকে বলে জানে না। জানে না দেশ, সরকার, গণতন্ত্র আর মৌলিক অধিকার কাকে বলে? কিন্তু অদ্ভুতভাবে তার ভেতর জেগে ওঠা এ সকল মূল্যবোধ এবাদত কলুকে ভিন্নতর মানুষে রূপান্তরিত করেছে। ৪ঠা এপ্রিল হঠাৎ করেই সে তার বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ঘানিকর্ম বন্ধ করে উঠানে মাদুর পেতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। তার বক্তব্য- যত দিন পর্যন্ত সে প্রধানমন্ত্রীর বলতে না পারবে ততদিন পর্যন্ত সে এভাবেই থাকবে। খাবে না, ঘরে যাবে না, মরে যাবে। এবাদত কলুর এ অনশন ভাতুড়িয়া এবং পাশাপাশি এলাকায় বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। প্রতিদিন এবাদত কলুকে দেখতে দূর দূর থেকে লোকজন ভিড় করছে। এবাদত কলুর অবস্থাকে মতিভ্রম, কেউ কেউ জীন-পরী ধরেছে বলে চিহ্নিত করতে চাইছে, কেউ কেউ আবার তাচ্ছিল্য, কৌতুকও করছে। অল্প সংখ্যক লোকই বুঝিয়ে শুনিয়ে এক আধটু খাদ্য দ্রব্য খাওয়ানোর চেষ্টা করলে সে অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করেছে। দুর্বলতার কারণে এবাদত কলু এখন কথা বলতে পারছে না এবং ওঠে বসতেও পারছে না। এবাদত কলুর এ অবস্থার কারণে তার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে সান্টু না খেয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এবাদত কলু একজনই কিংবা এবাদত কলুর পরিবার একটাই; তারপরও প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন এবাদত কলু দেশের একটি নির্দিষ্ট অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে তাহলে এবাদত কলুর এলাকা সফর করে একটি পরিবারকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচাতে পারেন, এ ছাড়াও এর সাথে ভাতুড়িয়া গ্রামের অত্যন্ত জীর্ণ দুরবস্থার সম্পর্ক রয়েছে। আলাপ-আলোচনাকালে ঐ অঞ্চলের লোকজন সরকারের পৃষ্টপোষকতা প্রত্যাশা করেছে।
একটি চিঠি হইতে ভাতুড়িয়া তাঃ ১০/০৫/৯৩
সাংবাদিক ভাই সাহেব
হাজার কুটি সালাম রহিল। আশা করি মহান আল্লাহর কৃপায় মঙ্গল মতেই আছেন। পর সমাচার এই যে, আপনারা চলিয়া যাইবার পর হঠাৎ করিয়াই একদিন জাতীয় পত্রিকায় এবাদত কলু সম্পর্কিত সংবাদ পড়িয়া অত্যন্ত পুলক অনুভব করিয়াছি। চিত্তরঞ্জন বাবু প্রথমে সংবাদটি পড়িয়া বাজারে সবাইকে দেখাইলে হৈ চৈ পড়িয়া যায়। শুধু তাই নয়। খবরের কাগজে এই সংবাদ প্রকাশের মাত্র দুই সপ্তাহ পর আমার ইস্কুলের মাঠে প্রধানমন্ত্রী জনসভা করিয়াছে। ভাতুড়িয়া এই প্রথম এত লোকজনের সমাগম হইয়াছিল। প্রধানমন্ত্রী আসিবার এক সপ্তাহ আগে হইতে যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছে। তাহা বলিয়া শেষ করা যাইবে না। শহর হইতে অনেক মিলিটারী আসিয়াছিল। খাল-ডোবা-পুকুরের কচুরিপানা পরিস্কার করিয়া সেইখানে মশার ঔষধ ছিটাইয়া দিয়াছে। বাজার হইতে যে সড়কটি আমার ইস্কুলে আসিয়াছে তাহা একদিনের মধ্যেই ইট বিছাইয়া দিয়াছে। উপজেলার সকল অফিসার বসিয়াছিল আমার অফিসে। তিন তিন-খানা গেইট করিয়াছিল। যদি আপনাদের দেখা পাইতাম তাহা হইলে আরেকবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতাম। প্রধানমন্ত্রী অনেকক্ষণ ধরিয়া বক্তব্য রাখিয়াছিল। বলিলেন খুব শীঘ্রই ভাতুড়িয়া গ্রামে বিদ্যুৎ আসিবে, জেলা সদর হইতে পাকা সড়ক আসিবে, মজা খাল সংস্কার করিয়া কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা করা হইবে। ভাতুড়িয়ার দরিদ্র কৃষকদের ঋণের কথাও বলিলেন। বলিলেন বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করিতে তিনি কাজ করিয়া যাইতেছেন। অবশেষে তিনি ভাতুড়িয়ার দুইটি মসজিদে ৫০ হাজার টাকা, আমার স্কুলটি পাকা করিবার জন্য ১ লক্ষ টাকা দিবেন বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। এ ছাড়াও তিনি নিজের হাতে গরিবদের মাঝে শাড়ী, কম্বল, লুঙ্গি ও গেঞ্জি বিতরণ করিয়াছেন। সভা শেষ হইলে তিনি পায়ে হাঁটিয়া এবাদত কলু ততদিন বাঁচিয়া ছিলেন না। আপনারা যাওয়ার তিনদিন পরই এবাদত কলু মারা গিয়াছিল। মারা যাওয়ার সময় অস্পষ্ট দুই-একটি কথা বলিতে চেষ্টা করিয়াছিল। আমি পাশে ছিলাম এবং কান পাতিয়া শুনিয়াছি। সে বলিয়াছে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে যদি কোনদিন দেখা হয় তাহা হইলে যেন তার কথাটা পৌঁছাইয়া দেই। প্রধানমন্ত্রী এবাদত কলুর বাড়ির চারিদিক ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিলেন। তার বউ ও সান্টুর সাথে কথা বলিলেন। অতপর এবাদত কলুর বউ-এর হাতে একটি চেক দিয়া বলিলেন, এবাদত কলু একজন অশিক্ষিত লোক ছিলেন; কিন্তু তিনি যাহা করিয়া গেলেন তাহা জ্ঞানী ব্যক্তির চাইতেও মহান। আমি তাহার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছি। প্রধানমন্ত্রী চলিয়া গেলে আমি দেখিয়াছিলাম চেকটার মূল্য ছিল ২০ হাজার টাকা।
ইতি শহীদুল আলম ভাতুড়িয়া
আধযুগ পরের একটি স্থির চিত্র
এ ঘটনার আনুমানিক আধ-যুগ পর শহীদুল আলমের সুবাদেই আমার পুনরায় ভাতুড়িয়ায় আসা। আসার পথেই আমি এবাদত কলুর উঠানে উঠি এবং দাঁড়াই। আমাকে কেউ চিনতে পারেনি, তবে আমি চিনে উঠমে বিলম্ব হয়নি। উঠানের মাঝখানে মাদুর পেতে যে মহিলা কুঁচকে পড়ে আছে তিনিই এবাদত কলুর স্ত্রী আলিমুন। আরও একজন কমবয়সী যে একজন মহিলা আঙ্গিনায় বসে একটি শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে, দেখে অনুমান করি সান্টু বিয়ে করেছে। এ বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছি যখন দেখি সান্টু দুই-তিন বছরের অপর একটি শিশুকে কোলে নিয়ে ঘানির আসন-তক্তার উপর বসে ঘোড়ার পিঠে চাপড় মারছে এবং ঘানির ক্যাৎ---ক্য---া----ৎ----ক্যা-----ৎ---ৎ শব্দের সাথে লয় মিলিয়ে গীত গাইছে--------- আমার আন্ধাইর ঘরের মানিক ঘোড়া আন্দুস পইরা কলুর ঘানি ক্যাতর ক্যাতর টানে রে মহাজনের দেনা দিনে দিনে বাড়ে রে।