ওঁম্ শান্তি ওঁম্ - কামরুল হুদা পথিক

কামরুল হুদা পথিক

সম্পাদক: দ্রষ্টব্য ও করাতকল

সর্বশেষ

Home Top Ad

আপনি জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামের বুনোশুয়োর আপনাকে থাকতে দেবেনা কারণ, তাদের ‘ঘি’ বলেন আর ‘গু’ বলেন কোন কিছুতে ‘না’ নেই

বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৯

ওঁম্ শান্তি ওঁম্

...যাহা একটি গদ্য কিংবা একটি গল্প কিংবা কিছুই না... তবে পাঠক, কিছু একটা নির্ধারণ করে পাঠ করতে চাইলে ‘এন্টি’ বিশেষণটি পূর্বপ্রয়োগ অনিবার্যবোধ করি...

১.
কোনো ফাঁক পেলে সে পথে ঢুকে পড়বে বেনো জল, ধ্বংস করবে 
জ্ঞান ও চৈতন্য, এক মধ্যবিত্ত ষন্ডে পরিণত করবে, যে বেঁচে 
থাকবে খাদ্য সংগ্রহ, সহবাস ক্রিয়া ও প্রকৃতির জৈব 
ষড়যন্ত্রের নাটবল্টু হিসাবে-
-শৈলেশ্বর ঘোষ

মাঠের পর মাঠ পার হয়ে কোনো এক জঙশন থেকে বের হয়ে চলে গেছে রেলপথ অস্পস্ট সুতোর মতো। সে পথ ধরে কতশত রেলগাড়ি চলে গেছে, চলে যাচ্ছে, আর চলে যাবে-তার হিসেব রাখার প্রয়োজন কেউ মনে করেনি। কিন্তু সেসব রেলগাড়ির হুইসেলের কুহক জালে মোড়ানো শব্দ আমাদের মনোজগতে সক্রিয়তা হারায়নি। ভরদুপুরের ডাক কোনো ভাবেই সন্ধ্যাবাতির ডাকের সাথে হুবহু মেলাতে পারিনি, যেমনি মেলাতে পারিনি সন্ধ্যাবাতির ডাকের সাথে কোনো প্যাঁচা ডাকা মধ্যরাতের কিংবা কুয়াশা ভেঁজা ভোর-রাতের ছুটে চলা রেলের বাঁশি। কী এক অদ্ভুত মায়ার জালে ঘেরা যেনো এই মায়াবি বাঁশি। কতশত মানুষ এই মায়াবি ডাক শুনে কত ধরনেরই না নস্টালজিক হয়েছে। মন ভালো করা মন খারাপ করা, কত স্মৃতি-বিস্মৃতির জংধরা ঘরদোরের তালা খোলার চাবি হয়ে কাজ করেছে রেলগাড়ির এই বিমূর্ত হুইসেল কিংবা কুহক বাঁশি। 

জঙশন থেকে বের হওয়া রেলগাড়ির হুইসেল কখনো সঙ্গীতের দোলায় কোনো এক অচেনা নদীতে অচেনা মাঝির কণ্ঠের সাথে মিশে গেছে, কখনো কোনো এক নতুন ছন্দবৃত্তে দুলতে দুলতে অচেনা বাগানে রঙবেরঙ-এর অচেনা ফুল ফুঁটিয়েছে, আবার কখনো ভারি গদ্যের জটিল কোন মার্বেল স্টাইকার হয়ে কোনো এক অচেনা ক্যারমস-এর জমাট মার্বেল গুটির উপর আছড়ে পড়ে সবকিছু ল-ভ- করে দিয়েছে। কিন্তু কোনোটাই বহুক্ষণ চলমান থাকেনি। যেনো হঠাৎ বৃষ্টির মতো, হঠাৎ বানকুড়োলির মতো, হঠাৎ ভূকম্পনের মতো কিংবা হঠাৎ সুনামীর মতো সবকিছু ল-ভ- করে দিয়ে সহসা নিজেকে বিলীন করে অন্য এক শান্ত সৌম্যতায় মূর্তমান প্রতীকি বাঁশি আমাদের শুনিয়ে যাচ্ছে সাবধানি আর সম্মুখে সৌরম-লের নতুন কোনো ছায়াপথের ছায়া সঙ্গীত।

এই হুইসেল কি আগুন থেকে উৎসারিত কোনো শক্তি? যে উৎসে লুকিয়ে থাকে কোনো সৃষ্টির আদি বীজ অথবা লুকোনো ছিলো আমাদের চর্যাগীতির আদি উপাখ্যান? সেখান থেকেই কি কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের শিল্প সৃষ্টির তাড়না? কোনো কাব্য, কোনো গদ্য, কোনো সুর, কোনো তৈলচিত্র, কোনো ভাস্কর্য, কোনো ছবিওয়ালার লংশর্ট, না ছাপাখানায় কোনো কাগজের প্রসব বেদনার কলের শব্দ? আমরা মেলাতে চাই যার যার মতো করে। আমরা কি আগুন থেকে উৎসারিত সেই হুইসেলের শব্দ শুনতে পেয়েছি? নাকি নিজেরাই হয়ে উঠেছি অথবা ছিলাম অজ্ঞাতে সেই হুইসেল? নাকি জন্মান্তরে পাওয়া এই হুইসেল বাজিয়ে চলেছে রেসের মাঠে পরবর্তি কোনো রেসের- হাতে তুলে দিতে?

অগ্নি উৎসে জন্মানো এই হুইসেল যেনো পরম শক্তি আহরিত, যে শক্তির বিস্ফারিত চেইন বিক্রিয়া আহরিত শক্তিকে বহুমাত্রিকতায় প্রসারিত করতে থাকে আর একই সমুদ্রে ডুব দিয়ে একেকজন একেক ধরনের মন্ত্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। সে যখন নিজেই এইরূপ শক্তিতে পরিণত, তখন নিজের ভিতর এই শক্তির বহুমাত্রিক বিক্রিয়ার তোলপাড় কোনো গর্ভে বেড়ে ওঠা মায়ের সৃষ্টি সুধা স্বপ্নে মোহিত কষ্টকর অতিক্রান্ত পথের সাথে মেলাতে থাকে। সে তখন সে থাকে না, সে হয়ে ওঠে অগ্নিস্বত্ত্বা, মন্ত্রসিদ্ধ, অপ্রোলুব্ধ আর আত্ম-অহমে ডুবে থাকা এক প্রাণ-যে প্রাণ নিজ ভূমে কখনো স্ববাসি আবার কখনো পরবাসী।

অগ্নি উপাসক কে হবে আর কে হবে না সে কথা ভিন্ন কিন্তু পিঠার পেটের ভাগে ফুলে ওঠা তিলের সৌরভ আনতে কিংবা যে শর্করা আমাদের প্রাণের বীজ, তাকে পাকস্তলীর উপজিব্য করতে অগ্নিই নমস্য। ঊনবিংশ শতাব্দির শিল্প বিপ্লবের মূল স্টিম এখনো শিল্পের আদি পাঠই। আমরা দেখে অভ্যস্ত আগুনের চুল্লি থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের কোষ থেকে কোষের অগ্রযাত্র, আর আমরা মাতৃগর্ভে জানি ছিলো না কোনো আগুনোর শিখা কিন্তু আমাদের পেছনের পথ জুড়ে ছাপচিত্রে স্পষ্ট হয়ে আছে অগ্নিকথন, যা জন্ম জন্মান্তর মুলসূত্র আর সকল উত্তাপের উত্তরোত্তরের আদি-বাড়ি সূর্য। সৌর ম-লের এই মহাগ্রহটি এ ভাবেই পুরাণের পথ ধরে আজ কারও কাছে দেবতা, বিজ্ঞানে যা শক্তির আঁধার, দার্শনিকের চোখে, চিত্রময়তা-ওঁম শান্তি। 

সৃষ্টি←মানুষ←ভ্রুণ←মাতৃগর্ভ 
আলো→সালোক সংশ্লেষণ→পুষ্টি 
উত্তাপ←সূর্য←সৌরন্ডল←কৃষ্ণগহ্বর 
সৃ ষ্টি র হ স্য
ওঁম্→সৃষ্টি←ওঁম্
ওঁম্→শান্তি←ওঁম্
ওঁ ম্  সৃ ষ্টি,  ওঁ ম্  শা ন্তি


২.
ঈসা মুসা, শ্রী চৈতন্য, সে প্রেমেতে অচৈতন্য
ভেবে শূন্য হোলি শূন্য পায় সে হইলে ভুল 
পুরুষ নির্গূন ব্রক্ষ্ম, লীলাতে সর্গূন কর্ম
বুঝে দেখনা সূক্ষ্ম মর্ম, অবতীর্ন সূক্ষ্মস্থল
-মহর্ষি মোনমোহন দত্ত

মাতৃগর্ভের ভ্রুণেই খুব সযতনে বুনে দেয়া হয় কোনো আগুনের বীজ। বুনে দেওয়া বীজ পার্থিব আমাদের অনেকের বয়ে বেড়ানো বীজঘুম, কারও জীবন জুড়ে বিস্ফারিত শাখা-প্রশাখা। এই ফিস্ফারিত ওম-এর মাত্রাই মানুষকে মানুষ থেকে ভিন্ন করেছে, দিয়েছে সৃষ্টির বেদনা, করেছে দৃষ্টির বহুমাত্রিকতা, নিবিষ্ট করেছে সৃষ্টি সুধা রসে। তাই প্রসবিত সৃষ্টি দ্বারা আমরা তাড়িত হই আবার অন্য কোনো সৃষ্টির প্রসব বেদনায়। সেই রেলগাড়ির নস্টালজিক বাঁশি যেন ওম্ দিয়ে যায় সৃষ্টির উন্মাদনায় আর আমরা তখন সৃষ্টি করি মূর্ত-বিমূর্ত শিল্পকলার পত্রপুঞ্জ। বহুদূরের সেই হুইসেল মাঝরাতের ঘুম-নির্ঘুম যাত্রীদের নিস্তÍব্ধতাকে ভেঙেচুরে যখন জঙশন থেকে বেরিয়ে যায় আবার একই সাথে দেখতে থাকি কিভাবে ধীরে ধীরে ঢিল পড়া জলের বৃত্তাকার ঢেউ ক্রমশ ফিরতে থাকে শান্ত সৌম্যতায়। শিল্পের পেছনে সেই রেলগাড়ির হুইসেল বলি, অগ্নি উত্তাপ বলি আর ওম্ বলি-সবকিছুই শিল্পীকে ওরকম কিছুটা ভেঙে চূরে দেয়। সৃষ্টির বোনা বীজকে ওম দিয়ে দিয়ে জুড়ে দেয় চোখের মণি। সঞ্চারিত করে রক্তের প্রবাহ আর মনের ভিতর অদৃশ্য কোনো ইশারা। যেখান থেকে শিল্পী হয়ে ওঠে বেটপ কোনো অসামাজিক, অবৈশ্বিক আর নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে বনে-জঙ্গলে খড়কুটোয় কিংবা অদৃশ্য পরাশ্রয়ে ওম্ দিতে থাকে কোনো পদ্য, কোনো গদ্য, কোনো তৈলচিত্র, কোনো ভাস্কর্য, কোনো রাগিনী কিংবা কোনো সৌরকণিকার প্রাথমিক বীজে। পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন কিংবা বুদ্ধদেব বসুর রবীন্দ্রবলয় ছেঁড়ার মন্ত্রগদ্য, পিকাসোর গোয়ের্নিকা, কমলবাবুর অন্তর্জলির যাত্রা, অমিয় ভূষণের ফ্রাইডে আইল্যান্ড, এস এম সুলতানের ফার্স্ট প্লান্টেশন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সরোদে বিমূর্ত রাগ আর সেকালে চাঁদে যাবার স্বপ্ন বাস্তবতা।

শিল্পী আর বিজ্ঞানীর মধ্যে আসলে প্রভেদ কতটুকু? আছে আবার নেইও। দু’জনই ওম্ প্রাপ্ত দু’জনই ওম্ ত্রাতা, দু’জনই মাইক্রো, দু’জনই ম্যাক্রো, দু’জনই আপগ্রেডেড পিক্সেল লেন্সের কৃষ্ণমণ্হ্রিদ। দু’জনই অন্ধ আবার দু’জনই দ্রষ্টা। দু’জনই স্বপ্নান্ধ আবার দু’জনই স্বপ্নস্রষ্টা। ফলে আদিকাল থেকেই এই দু’জন কোনা না কোনো ঐন্দ্রজালিক বাঁশির ওমে তাপিত হয়ে সৃষ্টিসুধায় বিভোর আর এই প্রবহমানতা কোনো জলপ্রপাতের মতো জনসাধারণ্যে নান্দনিকতা, স্বপ্নময়তা, দৃশ্যময়তার স্বরূপে অনাবিষ্কৃত আজও এবং সুদূর অতিতেও তা অনাবিষ্কৃত ছিলো এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। যেমনি আমরা মেলাতে পারিনা এখনো মাঝরাতের হুইসেলের সাথে ভোরের হুইসেলের কুহক বেড়াজালে আচ্ছন্ন থাকা কোনো অনাবিষ্কৃত তত্ত্বের মর্মকথা।

শিল্পী জানে সৃষ্টি, শিল্প পায় সুধা। শিল্পী নিজেকে নিয়েই একসময় খেলা শুরু করে, নিজেই হয়ে ওঠে কাঁচামাল। সৃষ্টির যেমন মাত্রা বদলের অভ্যেস, শিল্পীর নিজেরও থাকে মাত্রা বদলের অভিলাস। শিল্পীর কোনো কালে কোনো কাজে পরিতৃপ্তী মেলে না। তাইতো শিল্পী শুনিয়ে যায়, নিঃশ্বাস বন্ধের আগে-সময় গেলে সাধন হবে না। শিল্পী শুনিয়ে যায় আমি তো সারা জীবন সমুদ্র পাড়ে কিছু নুড়ি পাথর কুড়ানোর চেষ্টা করেছি। শিল্পী শুনিয়েছে কঘঙড ঞঐণঝঊখঋ-এর মতো সরল ও গভীর উপলব্ধির ভাষ্য আর আমরা জেনেছি হেমলক পানের রাষ্ট্রীয় নির্দেশ। শিল্পী শুনিয়ে যায় তার অপূর্ণ কবিতা অথবা অনাবিষ্কৃত নতুন কোনো সৌরগ্রহে অবারিত জলরাশির সম্ভাবনার কথা। শিল্পী ঢুকে পড়ে কৃষ্ণগহ্বরে অন্য কোনো কৃষ্ণগহ্বরে থাকার সম্ভাবনার পিছনে- শেষবধি শিল্পী শোনাতে চায় তার অপ্রাপ্তিরই কবিতা ও আবিষ্কার।

শিল্পীর প্রাপ্তি তার সৃষ্টির আনন্দ 
শিল্পীর প্রাপ্তি তার অর্পূতার বেদনা
তাই শিল্পীর সমীকরণ হয়ে ওঠে 
শিল্পীর সৃষ্টি←→ অপূর্ণতার বেদনা
বেদনাই শিল্পীর শেষ কথা। যে মুহূর্তে শিল্পী কোনো সৃষ্টির আনন্দে বিভোর পরক্ষণেই তাকে হাতে নিতে হয় নিজ হাতে বানানো সৃষ্টি ভাঙার হাতুড়ি-বাটাল। শিল্পী তো জানে প্রজাপতির ডানায় অসম্ভব পেইন্টিংস-এর গূঢ় কাহিনী, আরও জানে এই অসম্ভব গূঢ় কাহিনী বিনাশের রহস্যময়তা ও মাদকতা। আহা! আমি যেনো হতে পারি প্রজাপতি, আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আমি বিনাশে সঙ্কিত নই কিন্তু একবার সৃষ্টি করে যেতে চাই প্রজাপতির বিচিত্র-বর্ণিল পাখার চিত্রকলা।

শিল্পী তো অবৈশ্বিক। ঋত্ত্বিক বাবুর যাপন কালই কিংবা আমাদের মধুসূদন এর ধার দেনায় জীবনাবসান-এইসব উদাহরণ হয়ে ওঠে এক একটা শিল্প। শিল্প তো কখনো পণ্য নয়, নয় কোনো ফর্মালিন দেয়া আপেল, নয় কোনো মমি বানিয়ে যুগযুগান্তরে জাদুঘরে কাচবাক্সে বন্দী থাকার বিলাসিতা। শিল্প আসলে ভাঙচূরের এক রাসায়নিক বিক্রিয়া। তাই শিল্প বিকোবে কখন আর মুনাফার হিসাব কষার দাপ্তরিক অফিস বানাবে কী ভাবে? শিল্প তো কোনো পয়সা কামানোর ফ্যান্টাসি নয়। শিল্পর পরিচয় শিল্পই। শিল্পই প্রথম কথা, শিল্পই শেষ কথা। শিল্পী নিজেই শিল্পী এবং নিজেই শিল্প। যে কোনো উত্তাপ বা ওম্ তার তাড়না। শিল্পী নিজে ভাঙে ফলে তার শিল্পও ভাঙে। শিল্প টেকসই এমন কোনো বিষয় নয় যা যুগযুগ ধরে চলবে কিংবা বেঁচে থাকবে অথবা বাঁচিয়ে রাখা হবে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কেনো আইসিইউতে। শিল্পী যেহেতু বারবার নিজের মৃত্যু রচনা করে ফলে শিল্প বারবার তার মরণ দশা অতিক্রম করে। শিল্প কোনো রেসের কাঠি নয় যে হাত বদল করে করে লাল ফিতা স্পর্শ করার জন্য অগ্রসরমান থাকবে বরং অবৈশ্বিক শিল্পী বারবার হারিয়ে ফেলে তার রেসের কাঠি আর খুঁজতে থাকে পানা-পুকুরে আলো-আঁধারে তার হারিয়ে যাওয়া কাঠি। শিল্পী নিজেকে আক্রমণ করে, নিজেই নিজের সাথে দ্বান্দ্বিকতায় ভোগে, নিজেই নিজেকে শত্রু চিহ্নত করে, নিজেই অস্বীকার করে স্বয়ং নিজের কায়াকে। ফলে শিল্পী আজ যে শিল্প সৃষ্টির ঢোল-বাদ্যির পসরা সাজায় কাল সে নিজেই সকল পসরা দশমীর অঞ্জলী বানায়। ফলে তার শিল্প বিজ্ঞাপিত হওয়ার কোনো সুযোগই থাকে না। তাই-
তার শিল্প পণ্যই হবে কখন?
তার শিল্প বিকোবেই বা কখন?
আর মুণাফা...?

৩.
দাঁড়ানোর জমি পরীক্ষা করছি বারবার
THE UNEXAMIND LIFE IS
NOT WORTH-LIVING-
-সুবিমল মিশ্র

তাহলে শিল্প নিয়ে কি মুনাফা হচ্ছে না? হচ্ছে, শিল্প নিয়ে হচ্ছে, শিল্পীকে নিয়েও হচ্ছে। ওটা ব্যবসায়ীদের কাজ, ব্যবসায়ী বোঝে মুনাফার তত্ত্ব যা শিল্পীর বোঝার কথা নয়। 

শিল্পী ≠ ব্যবসায়ী 
শিল্প ≠ পণ্য
শিল্পী→সৃষ্টি→সুধা→নির্বান 
ব্যবসায়ী→পণ্য→মুনাফা→বিলাস।

ব্যবসায়ী বোঝে শিল্পী যতোই বোকাই হোক না কেনো, সেখান থেকেই মুনাফা বানানো পয়:-প্রক্রিয়া। শিল্পীর ছিড়ে ফেলা, ভেঙে ফেলা, অস্বীকৃত, বাতিল ঘোষিত, নিজেকে সাধারণে রেখে দেয়া কিংবা স্বনির্মিত তীরধানকে-কী ভাবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া নিষিদ্ধ পলিথিনের মতো পুণরায় মুনাফার উপজিব্য করে তোলা যায়, নিলামের উপজীব্য করে তোলা যায়, আর এগুলোর মূল্যমানের ম্যাজিক কাহিনী তৈরি করে মেলাকা- করা অর্থাৎ পণ্য বানানো যায় এবং বিক্রিত মালের মুনাফা পকেটে তোলা যায় শুধু মুনাফাই নয় মুনাফা লুটেরার ম্যাজিক কর্মময়তা তাকে শিল্পীর চেয়ে খ্যাতিমান করে তোলে আরেক মুনাফা লুটেরা-যারা এইসব ব্যবসায়ীর গলায় লকেট পরিয়ে দেয় অন্য কোনো ব্যবসায়ীর জার্নালের বিষয় হয়ে ওঠে। 

আপনি ইচ্ছে করলে
জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারবেন
কিন্তু
প্রতিষ্ঠান নামের
বুনো শুয়োর
আপনাকে ছাড়বে না
কারণ
তার ঘি বলেন আর গু বলেন
 কোনোটাতেই না নেই।

নমস্য লালন, তোমার সিদ্ধমন্ত্রকে আমরা পণ্য বানাতে পেরেছি।
ঋত্ত্বিক কুমার ঘটক, আপনার দরিদ্রপণার যাপনের সযতনে তোলা ছবি আমরা বাজারে নিয়ে এসেছি।
আমাদের কমল বাবু, আপনার ভাষা ভাঙার কাহিনী এখন বিকোয়।
ধানসিড়ির কবি জীবনানন্দ, আপনি এই মুহূর্তে হট অব দ্যা মার্কেট।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিসমিল্লা খাঁ আপনাদের এখনো সে মতে বাজারে তুলিনি কারণ
ল্যা- ডেভালপারের বিশেষজ্ঞ বলেছে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা।
বাবু মধুসূদন, আপনার নামে আমরা মেলা বসিয়েছি আর আপনার অবৈশ্বিক ও শেষ জীবনের মর্মান্তিক যাত্রাপালাই আপনার শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন।
বেঁচে থাকুন সুবিমল, আপনি সোনার গান্ধিমূর্তি বানিয়েছেন আমরা সোনার সুবিমল মূর্তি বানানোর কলাকৈবল্য বেঁচেবর্তেই দেখানোর ব্যবস্থা করবো।
আমাদের শামীম কবির, তুমি বেঁচে থাকতে দেখে যেতে হলো না তোমার প্রয়োজনের বেলেল্লাপণা।
ভ্যানগগ বলেন
গদার বলেন
জ্যাঁ লুক বলেন
পিকাসো বলেন
সুলতান বলেন
ঋত্মিক কুমার ঘটক বলেন
মৃণাল সেন বলেন
 হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেন
সলিল চৌধুরি বলেন
প্রতুল মুখোপধ্যায়
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বলেন
বিসমিল্লা খাঁ বলেন
লালন বলেন
শাহ আব্দুল করিম বলেন
জীবনানন্দ বলেন
বুদ্ধদেব বসু বলেন
শবদার হাসমী বলেন
হাবিব তানভীর বলেন
শোয়েব শাদাব বলেন
শামীম কবির বলেন
মানিক বন্দ্যোপধ্যায় বলেন
সুবিমল মিশ্র বলেন
রাজা সহিদুল আসলাম বলেন
তপন বড়–য়া বলেন
সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ বলেন
সেলিম মোরশেদ বলেন
ঋষি এস্তেবান বলেন

আপনাদের অপ্রাতিষ্ঠানিক চিন্তাকে, আপনাদের সৃষ্টির ভাঙাগড়ার খেয়ালিপনাকে আপনাদের নিজেদের বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াইয়ের বিষয়গুলোকে, আপনাদের যাপন সূত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পণ্য বানানোর জন্য আমরা ইতোমধ্যে গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছি। আমাদের গবেষণাগার ও গো বেষক দুটোই আছে। নিশ্চিত থাকবেন স্যার-আপনাদের আমরা অবমূল্যায়ন করবো না-করতেও দেবো না।

আপনি তিরোহিত হতে পারেন স্যার
আপনার হাড়গোড় তো আর তিরোহিত হবে না
ফসিল নিয়ে আমাদের যথেষ্ট পড়াশোনা আছে স্যার
আমরা আপনাকে যথাযথ মালে পরিণত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

৪.
১. ম্যানসাইসড ক্লিন্ট কাচের আয়না
২. হিট রেডিয়েশন গান
৩. ক্যান জানি না ভয়েস রেকর্ডার চালু, 
৪. আইস ব্লু দেয়ালের ঘের, শাদা ছাদ, ফ্যান, ক্রাটোনের পুরা এনগ্রেডিং
৫.  THE EXPERIMENT IS OVER
NOW I’LL HAVE A WALK SOME WHERE
YES I GOT MY FOOT
AND I START FOR GO
-শামীম কবির

মাঝরাতে রেলগাড়ির হুইসেল কি সেরকম কোনো যন্ত্রণারই আগমন বার্তা? জঙশনের মানুষগুলো নড়েচড়ে ওঠে। সরগরম হয়ে ওঠে এতক্ষণের ঝিমুতে থাকা শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো। ছুটাছুটি করতে থাকে ছুড়ে ফেলা কাচের মার্বেলের মতো। আমাদের জঙশনের ভাবনায় আর কী থাকে? কোনো উত্তাপে সে কি কোনো সৃষ্টিশীলতার বেদনায় দাহ হতে থাকে? একটা বাঁশি কী ভাবে পেলো এই ক্ষমতা? কী আগুন তার হাতে? যতোই এগুতে থাকে জঙশনের ভিতরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অবশেষে রেলগাড়ির জঙশনে দেখা মেলে আর খাঁচার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে পড়ে এতোক্ষনের তা-পনা। অতপর আবার বাঁশি আর সৃষ্টির এক ফাঁকা জঙশন, সৃষ্টি হয় শূন্যতা। আসলে জঙশন তো কোনো থেমে থাকা জায়গা নয়। জঙশনে টিকে থাকে বিনাশের বিলাপ, মাঝরাতে কোনো কুকুরের মায়া কান্না, জঙশন ভুলে যায় প্রসব বেদনা এসব মায়া কান্নার কুহকজালে। 

শিল্পী তো পেয়েছে সুধারস অতপর শিল্পের হাতুড়ি-বাটল নিয়ে শিল্প ভাঙার খেলা। তাই শিল্পীর শিল্পশালা শূন্যই থেকে যায়। থেকে যায় শিল্পীর অপূর্ণতা। হাতড়াতে থাকলে খুঁজে পাওয়া যায় আশেপাশে ধূলো-বালিতে ডুবে থাকা আস্ত কিংবা আধা সৃষ্টি। এসব বেদনা তো তাকে ঘিরেই থাকে। শিল্পী আগুনে পুড়ে পুড়ে নিজেই আগুন হয়ে ওঠে, শিল্পী হুইসেল শুনে শুনে নিজেই হুইসেল হয়ে ওঠে। শিল্পী অদৃশ্যময়ে থেকে থেকে নিজেই অদৃশ্য হয়ে ওঠে, শিল্পী শিল্প স্রষ্টা হয়ে নিজেই শিল্প স্রষ্টা হয়ে ওঠে। এসব কর্ম-অকর্ম শিল্পীকে শিল্প করে তোলে আর একদা আগুনমুখো যাত্রা শুরু করে। সমস্ত অগ্নি উৎসারিত সৃষ্টিসুধা সে পান করেছে অথচ কারোর জন্য সে কোনো সৃষ্টি রেখে যায় না-সে করেও না। তাহলে তার এই কর্মময় জীবনের মর্মার্থ কি?
IT’S NOTHING
IT’S NOTHING
IT’S NOTHING
চে’গুয়েভারার রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ার জন্য তৈরি ঐ মদ্যপ সৈনিক আর ৭টি বুলেটের স্রষ্টা কে? চে’গুয়েভারা নিজেই। সে তো জেনে শুনেই শুরু করেছিলো আগুনমুখো যাত্রা। শিল্পীতো মখমলের ঘ্রাণ নেয়নি-সে নিয়েছে আগুনের ঘ্রাণ। শিল্পী আজ যা পান করে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে কাল তা পান করে যৌবন বিসর্জন দিয়েছে। শিল্পী তো কখনো ঘুমোতে আসেনি, কোথাও থেমে থাকতেও আসেনি। শিল্পী চায়নি বটবৃক্ষ হতে অথবা তাকে বনসাই বানানোর বিকৃত মস্তিষ্কের উপকরণ হতে। সে অবস্থা বদলে ফেলেছে, সে নিজের রূপ বদলে ফেলেছে, সে ভাঁজ পড়া জং ধরা খোলস বদলে ফেলেছে বারবার, ফলে সে থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাইতো তার আগুনমুখো যাত্রা। একমাত্র আগুনের কাছেই সে ঋণী কারণ আগুন থেকেই উত্তাপ কিংবা ওম তাকে সৃষ্টিশীল করেছে এবং এখনো রেখেছে। তাই আগুনের কাছেই তার বানানো শেষ সৃষ্টিশিল্প সমর্পন করে তার ঋণ শোধের প্রয়াস এবং শিল্পীর শেষ শিল্পের নাম হয়ে ওঠে বিনাশ শিল্প।

লালন, ঋত্ত্বিক, চে, মধুসূদন, জীবনানন্দ, শৈলেশ্বর, চ্যাপলিন, আলাউদ্দিন, বিসমিল্লা খাঁ... আর যারা যারা আগুনের আঁচ নিয়ে ভীড় থেকে বেরিয়েছেন কিংবা তাদের যারা সেই মোহনীয় বাঁশি শুনে অনাবিষ্কৃত পথে যাত্রা করার প্রেরণা পেয়েছেন কিংবা জঙশন থেকে বেরিয়ে পড়ার গল্পটা আত্মস্ত করে শেষাবধি নিজেকে শূন্য করে ভারমুক্ত রাখতে চেয়েছেন এবং পেরেছেন-তাঁরা কার কাছে ঋণী হবেন? তাঁরা আসলে নিজে ঋণগ্রস্ত হতে আসেনি আর কারো ঋণী বানাতেও আসেনি। তারা উপসানালয়ে সিরনি দেয়ওনি তার উপাসনালয়ের সিরনি খায়ওনি।
NO DEBIT NO CREDIT
ZERO DEBIT ZERO CREDIT
SO

BALANCE→ 0 ←BALANCE
সুতরাং শিল্পী নিজেই শ্মশানের চিতা বানায়। শিল্পী নিজেই শব, নিজেই শব যাত্রী। শিল্পী নিজেই ব্রাক্ষ্মণ নিজেই চ-াল। শিল্পী নিজেই শোধ করতে চায় আগুনের ঋণ। তাই শিল্পী আগুনের চিতায় অর্ঘ্য দিতে চায় তার জীবনের শেষ সৃষ্টি শেষ শিল্প। শিল্পী অবলীলায় আগুন থেকে সুধা আহরণ করে নিজেকে শুইয়ে দেয় চিতার আগুনে। শিল্পী অবগাহন করে শিল্পীর শেষ শিল্প নিজেকে বাতিল করার মহাকর্মযজ্ঞে। বানাতে চায় জীবনের শেষ শিল্প-যার নাম বিনাশ শিল্প। নিজেকে সমর্পনের মধ্য দিয়ে ঘুমোতে চায় চিরদিনের মতো আর যতক্ষণ ঘুম আসে না ততক্ষণ শেষরাতের হুইসেল তাকে বহুমাত্রিক নস্টালজিক করে তোলে। শিল্পী দ্যাখে তার কতশত শিল্প, আস্ত-আধটুকরো শিল্প, যতনে গড়া যতনে ভাঙা শিল্প, ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় হয়ে ওঠা শিল্প, ছিঁড়ে ফেলা-ছুঁড়ে ফেলা শিল্প ডাস্টবিন-এসট্রে-ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে আসা শিল্প চিতার চারপাশে ভীড় করতে থাকে আর তার বিনাশশিল্পের মহা নির্মাণযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তাদের স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সমস্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করতে থাকে-ওঁম্ শান্তি ওঁম্...। ওদের চোখে জল গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে শিল্পী মুচকি হাসে, শিল্পী কাঁদে না কারণ শিল্পীতো কাঁদতে আসেনি। শিল্পী তো এই মুহূর্তে তার শেষ নির্মাণ বিনাশশিল্প নির্মাণে মহা কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত। আর সব শেষে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শিল্পী নিরুপদ্রব উপভোগ করতে চায় তার শেষ শিল্প নির্মাণের অবৈশ্বিক পাগলামো।

ঠিক তখন কে যেনো তার কানের পাশে পুরাণের গ্রন্থ থেকে ফিনিক্সপাখির গল্পটা শোনাতে থাকে...
A phoenix is a mythical bird with a colorful plumage and tail of gold and scarlet (or purple, blue, and green according to some legends [weasel words]). It has a 500 to 1000 year’s life-cycle, near the end of which it builds itself a nest of twigs that then ignites; both nest and bird burn fiercely and reduced to ashes, from which a new, young phoenix of phoenix egg erises, reborn a new to live again. The new phoenix is destined to live as long as its old self and some stories, the new phoenix embalms the ashes of its old self in an egg maid of myrrh and deposits it in the Egyptian city of Heliopolis (literally ``Sun city`` in Greck). It is said that the bird’s cry is that of a beautifull song. The phoenix`s ability to be reborn from its own ashes implies that it is immorartal, …………… …………… …… ……………………………………………………………………… 

গল্পটা তিনি কতক্ষণ শুনেছিলেন তা কেউ বলতে পারে না...

-কামরুল হুদা পথিক



Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages