হে সৃষ্টিশীলতা, নিজেকে নিজে আক্রমণ করার জন্য তৈরি থেকো
-সুবিমল মিশ্র
ভোরের ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো তাদের অহংকার। অসীম জলরাশি থেকে এই এক ফোটা শিশির বিন্দুর ব্যবধান কোনো পরিমিতির মধ্যে পড়ে না। বিষয়টা অনুধাবনের বিষয়টা চেতনার। এক একজনের মননে চেতনার বিকাশও এক এক রকম। কথা সাহিত্যই বলি আর পদ্য সাহিত্যই বলি- আমি সাহিত্য ও সাহিত্যিক প্রসঙ্গ নিয়েই বলছি। যিনি সাহিত্য করেন তিনিই সাহিত্যিক। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি সাহিত্যটা করবেন কোথায়? তারচেয়েও বড় কথা তিনি কোন সাহিত্য করবেন? তাহলে নিশ্চয়ই সাহিত্যের রকমফের রয়েছে। যাঁরা প্রকৃত সাহিত্য করতে আসেন কিংবা মহৎ সাহিত্য করতে আসেন তাঁরা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন কোনো প্রকৃত লেখাই অন্য কোনো লেখার নকল নয়। আর নকল কখনও মহৎ সাহিত্য হতে পারে না। কমল কুমার মজুমদারের ভাষাকে যে আক্রমণ করে সেই ভাষাকে বাঁচায়- এ কথাকে আত্মস্থ করেই প্রকৃত লেখকরা সাহিত্য করতে আসেন। আর তাঁর এ নতুন সাহিত্য ধারণ করবে কে? প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাগজ? বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া পাঠক কি এ সকল সাহিত্য গিলতে পারবে? নাকি গিলতে গিয়ে গলায় আটকে মরণাপন্ন অবস্থার শিকার হবে? বরং অতসব উটকো ঝামেলা এড়িয়ে চলাটাই প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান হয়ে উঠে। তাইতো যুগে যুগে নিজেদের শ্রমে-অর্থে নিজেদের নিরীক্ষা নিয়ে বের হয়েছে ছোটকাগজ। প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে ক্রমশঃ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা এ সকল কাগজই লিটল ম্যাগাজিন। সকল প্রকার প্রচলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে নিতে এক পর্যায়ে নিজের বিরুদ্ধেও নিজে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে। নির্মোহিত শামুকের মত নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখা কিংবা ঠ্যামকা নাচনেওয়ালাদের মতো নিজেকে ঢোলবাদ্দি করার প্রতি একপ্রকার ধিক্কার করার মধ্য দিয়ে অহংবোধ থাকে তাঁদের। এ অহংবোধ একেবারে তাদের নিজস্ব। দ্বিচারিণী স্বভাব নিয়ে একদল বসন্তের কোকিল ঢুকে পড়ে কিংবা ঢুকে পড়তে চায় এ অহংবোধের বর্গক্ষেত্রে। বিভ্রান্ত হই আমরা, বিভ্রান্ত করেও। শাহবাগের পিজিয়নে কিংবা আজিজ সুপার মার্কেটের সিঁড়িতে নির্ণয় হয়ে যায় ছোট কাগজের ভেদ-বিচার। সারা দেশের ছোট কাগজের উপর ছড়ি ঘুরানোর দুঃশাসন থেকে মুক্ত হতে পারে না প্রকৃত লেখকরা।
মোহভঙ্গ এবং নিদ্রাভঙ্গ দুই-ই। ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯২ সালে বগুড়ার রহমান নগরের কোনো এক দ্যুতিময় দুপুরে এবং ঢাকায় শাহ মোহাম্মদ আলম এর সাথে যোগাযোগ এবং ঐক্যমতে পৌঁছা। ঠিক এ রকমই একটি ছোট কাগজের কনসেপ্ট পেতে বজলুল করিম বাহারের সূত্র ধরে শাহবাগের পিজির মোড়ে শশ্রুম-িত তপন বড়–য়ার (সম্পাদক গা-ীব) সাথে হতাশা-উদ্দীপক ও উত্তেজনাপূর্ণ বাক্যবাণ-উদ্দেশ্য বিফলেই যেত যদি শাহেদ শাফায়েত (সম্পাদক পূর্ণদৈর্ঘ্য) এর সাক্ষাৎ আর সাবলিল ছোট কাগজের চেনা-দর্শন আত্মস্থ করা না যেত। মনে পড়ে মঈন চৌধুরীর (সম্পাদক প্রান্ত) বাসায় একপ্রস্থ আড্ডা, দেয়ালে টানানো ছবিগুলোর একটাই হয়ে ওঠে দ্রষ্টব্য প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ। নাসরিন জাহানের বাসায় আড্ডা দিতে দিতে নাসরিন জাহান, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, ফরিদ কবির, ব্রাত্য রাইসু, আশরাফ আহমদসহ অনেকে উঠে আসে দ্রষ্টব্য সূচিতে। এমত ঘেরাটোপ থেকে বের হওয়ার অদম্য চেষ্টা থাকার পরও ঐ একই বছরে দ্রষ্টব্য ২য় সংখ্যা বের করতে গিয়ে এসব সূচিবদ্ধতা থেকে অবমুক্ত হতে পারে না দ্রষ্টব্য। ব্রাত্য রাইসুর আঁকা প্রচ্ছদে বের হয় দ্রষ্টব্য ২য় সংখ্যা। চেতনা আর বিশ্বাসের দিক বিচার্যে না এসে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, হাফিজ রশিদ খান, হোসাইন কবির, কাজল শাহনেওয়াজ কিংবা শাহ মোহাম্মদ আলমদের পাশে সূচিবদ্ধ হয়ে যায় অঞ্জন সেন, বিবেক চট্টোপাধ্যায়, সুশান্ত মজুমদার-এর মতো সরল ধারার লেখকেরা। এসব দৃষ্টান্ত বিবেচনায় রেখে আত্মচরিত্রের উপর সন্দেহপ্রবণ বাক্যবাণ আমরা তুলে দরি বিশেষ দ্রষ্টব্যে- লিটলম্যাগ এর সংজ্ঞা আপেক্ষিক, তবে ধারণা স্পষ্ট। দ্রষ্টব্য- ‘ইহা একটি লিটলম্যাগ’ বলতে কুণ্ঠিত। আর যা থেকে মনে হয়েছে প্রতিশ্রুতি, পরমায়ু আর সূচিবদ্ধতার কথা নিয়ে বিশেষ দ্রষ্টব্য সাজালেও প্রকৃত অর্থে নিজেদের আক্রমণ করার তাড়না তড়পায় নিজেদের শিরায়।
লিটল ম্যাগাজিন : নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে
দাঁড় করিয়ে দেয়ার একটি চলমান প্রক্রিয়া
চলমান প্রথাকে ভাঙতেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা থেকে জন্ম নেয় অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনাবোধ। অতঃপর প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠান দ্বন্দ্ব। পশ্চিমবঙ্গীয় প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাকে আদর্শ মনে রেখে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো খুঁজে না পাবার এক কাল্পনিক চিন্তার করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বেহুস হয়ে পড়ে অনেকেই। তাই নকলকে ঢেকে রাখার যতই প্রসাধন চর্চা চলুক না কেনো সে প্রসাধন প্রলেপ উপচে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এক সময় নকলবাজির উত্তম উদাহরণ। এক সময়কার অপ্রাতিষ্ঠানিক মনোভাবাপন্ন বিগ বিগ অনেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ছেড়ে দেয় আর শুদ্ধ চেতনার বিশ্বাসগুলোকে কলুষিত করার জন্য মেধা বিকোতে থাকে। কিন্তু নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতোই (প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে) চলমান প্রথার বা গড্ডালিকা প্রবাহের বিপরীতে স্পষ্ট হয়ে উঠে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাগজের চেহারা। আর পশ্চিমবঙ্গীয় প্রাতিষ্ঠানিকতা না থাকলেও একই চরিত্রের ধারক ও বাহক আমাদের কাগুজে আর ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে সাহিত্য নিয়ে এক ধরনের ব্যবসাবৃত্তি (বেশ্যাবৃত্তি) করার প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রকে চিত্রিত করার স্পর্ধা দেখাতে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর তৎসময়কার ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে পড়ে। তথাকথিত মেধাকে অগ্রাহ্য করে বিকশিত চেতনাকে, সরল সাহিত্য ধারার বিপরীতে নিরীক্ষা বা এক্সপেরিমেন্টাল জায়গা করে দিয়েছে ছোট কাগজ। বাজারী, ব্যবসায়ী আর সকল প্রকার প্রচল-প্রচার-প্রবহমান সমাজ-সাহিত্যের প্রতি একধরনের রাগী চেহারাই প্রমাণ করে দেয় তাদের বিতৃষ্ণা, বিরোধিতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘৃণাও।
১৯৯৩ থেকেই দ্রষ্টব্য নিজেকে আরও সংহত করে সকল প্রকার প্রবল-সরল-গরল-সাহিত্য, দৈনিক-আধাদৈনিক আর এদের বি-টিমদের প্রতি বিতশ্রদ্ধতা প্রকাশে তৎপর হয়। লেখকদেরকে মৌলিক ও বাণিজ্যিক, আবার মৌলিক লেখকদের আপোষহীন ও আপোষকামী (কমিটমেন্ট ও ননকমিটমেন্ট সম্পন্ন) করে সম্ভব দেশ জুড়ে লিটল ম্যাগাজিনের কনসেপ্টকে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট থাকে। যেহেতু দ্রষ্টব্য কোনোকালেই গোষ্ঠীবদ্ধ, শ্রেণিবদ্ধ থাকতে চায়নি (এখনও চায় না) তাই অপ্রাতিষ্ঠানিক চেতনাধারী, নিরীক্ষাপ্রবণ লেখকদের আহ্বান, আগ্রহী আর ধারণ-লালন করার প্রত্যয় নিষ্ঠ হয়ে ওঠে। গা-ীবের সম্পাদকীয় উঠে আসে দ্রষ্টব্যে- যাঁরা ভুল পালক গুজে উচ্চকিত আস্ফালনে নতুন করে আন্দোলনে মাতছেন- তাঁদের বলি, অমরত্ব আছে অন্যপথে, অন্যধামে, এ ঘাটে নয়্ আর, কাক আর কোকিলের পার্থক্য চিহ্নতো চিরকালীন। দ্রষ্টব্য-৪ বেজে উঠে তারুন্য-তেজ-উদ্ধত্য-অবস্থান, লিটলম্যাগ লেখক-সম্পাদকদের পথভ্রষ্টতার আখ্যান। দ্রষ্টব্য-৩ এ এসে হোসাইন কবির (অধ্যাপক, চ.বি) এর মাধ্যমে আবিষ্কৃত হয়ে নতুন মাত্রার চিত্রশিল্পী শাহীনুর রহমান রহমান হয়ে যান দ্রষ্টব্যের প্রচ্ছদ শিল্পী। (দ্রষ্টব্য-৩ থেকে অদ্যাবধি দ্রষ্টব্যের প্রচ্ছদ শিল্পী শাহীনুর রহমান)। দ্রষ্টব্যসূচিতে আবিষ্কৃত হয় নতুন নতুন মাত্রার পদ্য ও গদ্য শিল্পীরা। শামীম কবির, কামরুজ্জামান কামু, মহীন মৃত্তিক, মজনু শাহ, রশীদ হারুন, সাদি তাইফ, হোসাইন কবির, আদিত্য শাহীন, সৈকত হাবিব, মুজিব ইরম, সৈয়দ তারিক, শান্তনু চৌধুরী, শাহেদ শাফায়েত, সঞ্চয় প্রথম, অতীন অভীক, মাসুদ আশরাফসহ অনেক কবির সাথে দ্রষ্টব্য গদ্য-গল্প সূচিতে চিত্রিত হয় রোকন রহমান, ঋষি এস্তেবান, মাসুদুল হক, মাসুমুল আলম, সুবিমল মিশ্র, সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ, কাজল শাহনেওয়াজ, ফারুক ওয়াসিফ, রাজা সহিদুল আসলাম, দেবাশিস ভট্টাচার্য, জিয়াউদ্দিন শিহাব, মোহাম্মদ ইমরান, বজলুল করিম বাহার, শোয়েব শাহরিয়ার প্রমুখরা। যাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল প্রত্যয়ী মনোভাব, স্ফুলিঙ্গের দ্যোতনা আর লিটল ম্যাগাজিনের আগামী স্বপ্ন। যেহেতু বড় কাগজের প্রাতিষ্ঠানিক বড় পাতার প্রতি ছোট কাগজের এক প্রকার বিতশ্রদ্ধতা-ঘৃণা থেকেই যায় সেহেতু আপাত অগ্রসর ছোট কাগজের লেখকশিল্পীদের একটু আলাদা আঙ্গিকে তুলে ধরার জন্য দ্রষ্টব্য প্রথমবারের মতো ছোট কাগজে ক্রোড়পত্রের ধারণার সূত্রপাত করে। যার মাধ্যমে ছোট কাগজের পাঠকের চিন্তায় জগৎকে আলোড়িত করতে তুলে ধরে গল্পকার কাজল শাহনেওয়াজ (দ্রষ্টব্য-৪, ১৯৯৩), কবি শান্তনু চৌধুরী (দ্রষ্টব্য-৫, ১৯৯৫), চিত্রশিল্পী শাহীনুর রহমান (দ্রষ্টব্য-৫, ১৯৯৫), মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দ্রষ্টব্যের নিবেদন (দ্রষ্টব্য-৬, ১৯৯৬)। আরও কর্মসূচির মধ্যে দ্রষ্টব্য ১ম সংখ্যা থেকেই বাংলাদেশের শহর-মফস্বলে বের হওয়া ছোট কাগজগুলোর চিন্তা-চেতনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বাধা-বিপত্তি এসব নিয়ে আলোচনা তুলে ধরে বিভিন্ন সংখ্যায়। চালচিত্র সম্পাদক রাজা সহিদুল আসলাম (ঠাকুরগাঁও), (দ্রষ্টব্য-১, ১৯৯২), লিরিক সম্পাদক এজাজ ইউসুফী (চট্টগ্রাম) (দ্রষ্টব্য-২, ১৯৯২) বিপ্রতীক সম্পাদক ফারুক সিদ্দিকী (বগুড়া) (দ্রষ্টব্য-৩, ১৯৯৩), গা-ীব সম্পাদক তপন বড়–য়া (ঢাকা) (দ্রষ্টব্য-৪, ১৯৯৪), অনিন্দ্য সম্পাদক হাবিব ওয়াহিদ (ঢাকা) (দ্রষ্টব্য-৫, ১৯৯৫)। এর চেয়েও বড় একটি বিষয় নিয়ে দ্রষ্টব্য ভাবতে শুরু করে। একজন লিটল ম্যাগাজিন লেখকের গ্রন্থটি কে বের করবে? খুব সহজে যে উত্তরটি পাওয়া যাবে তা হচ্ছে- এক. নিশ্চয়ই কোনো বেনিয়া প্রতিষ্ঠান নয় দুই. লেখক নিজেই তার গ্রন্থ প্রকাশ করবে। নিজের বই নিজে বের করার উদাহরণ অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কি লিটল ম্যাগাজিনের কোনো ভূমিকা নেই? আমি মনে করি অবশ্যই আছে। যেহেতু নির্মোহিক একদল লেখক বাজারী গড্ডালিকা প্রবাহের বাইরে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামমুখর থেকে লিখে লিখে লেখক হয়েছেন সেহেতু প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনই হওয়া উচিত এক একটি প্রকাশনা। যেখান থেকে বের হবে নিজের কাগজে বেড়ে ওঠা লেখকদের স্বপ্নের বইটি। দ্রষ্টব্য এ বোধটি অনুভব করে হাত দেয় কাব্য ও গদ্য লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশনায় এবং অব্যাহত এ প্রক্রিয়া প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ-এর গল্পগ্রন্থ আগুনের বিপদ আপদ ও শাদা কাহিনী, গদ্য বিষয়ক- বিষয় আঙ্গিক, শামীম কবীরের সমগ্র সাহিত্যকর্ম নিয়ে শামীম কবীর সমগ্র, মাসুদুল হকের গল্পগ্রন্থ তামাকবাড়ি, মজনু শাহ’র কাব্যগ্রন্থ আনকা মেঘের জীবনী, কামরুল হুদা পথিকের গল্পগ্রন্থ চাকার নিচে জীবন থেঁতলে যাচ্ছে, রিষিণ পরিমলের কাব্যগ্রন্থ নদীজলে চৈত্রদাহ। তারপরও মনে চেতনা বিশ্বাসে দ্বিধা সংশয় বাসা বেঁধে থাকে। মনে হচ্ছিল দ্রষ্টটব্য-৪ পর্যন্ত আমরা চেষ্টায় আন্তরিক থেকেও শেকল ভাঙতে পারিনি। যে কোনোভাবেই অযাচিত লেখক থেকেই যাচ্ছিল দ্রষ্টব্য সূচিতে। তাইতো দ্রষ্টব্য-৫ এ বিশেষ দ্রষ্টব্যে অবলীলায় বলে ফেলি দ্রষ্টব্যসূচি; ব্যর্থতায় দায়ভার নিজেদের। আর আশায় বুক বেঁধে সাধুবাদ জানাই প্রতিশিল্প, চালচিত্র, শব্দপাঠ ও চর্যাপদকে।
লিটল ম্যাগাজিন : নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে
দাঁড় করিয়ে দেয়ার একটি চলমান প্রক্রিয়া
পুঁজির আছে সকল কিছু গ্রাসাচ্ছাদি অগ্নিমুখ-লোভাতুর জিহ্বা-ডাইনোসরের উদগ্র স্বেচ্ছাচারী ক্ষুধা নিবৃত্তির কামুক প্রবৃত্তি। আর অসম্ভব অপশক্তির ধারক এই পুঁজিই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের মুখ। পুঁজি গিলে খেতে চায় সমাজ-সাহিত্য-সভ্যতা। কষ্টে-শিষ্টে হজম করতে চায় সবকিছু। আর পয়ঃনিষ্কাশনের মতো এক সময় উদগীরণ করে ফেলে দেয় আমিষটুকু চুষে নিয়ে। পুঁজির হাঁ-মুখ থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলে ছোট কাগজের প্রজ্ঞাশীল লেখকরা। কখনও কখনও তীব্র ঘৃণা কিংবা তীব্র বিরোধিতাকেও বেগবান করে তুলে এ সকল লেখকরা। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক কাগজের পিঠ চাপড়ানি মার্কা কর্মপ্রণালীর পাশে রাজনীতির মাঠে বি-টিমের মতোই বাজারি-বারোয়ারি-বাণিজ্যিক কাগজগুলোর ধ্বজামার্কা সাহিত্যের পাতাটির বি-টিম হিসেবে সাহিত্যের মাঠে অবস্থান করে বড় কাগজের সেবাদাস কিছু ভেকদারী ছোট কাগজ। বড় কাগজের কনটেন্ট জাস্ট ছোট পাতায় প্রিন্ট করে দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ থাকে না। নিরীক্ষাতো নেই-ই। ছোট কাগজের আগ্রহ যেখানে এক্সপেরিমেন্ট, বড় কাগজের আগ্রহ সেখানে নিরীক্ষাকে প্রত্যাখ্যান। তাই সব দেশে সবকালে সাহিত্যে সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি প্রবাহমান সেটি হচ্ছে সাহিত্যে কমার্শিয়াল বা বেনিয়াবৃত্তির পাশপাাশি প্রকৃত ও মৌলিক সাহিত্যনির্ভর অবিচ্ছিন্ন এক লিটল ম্যাগাজিনের বহমান স্রোত।
পাঠক, ধ্রপদ রাশান কবি সের্গেই ইয়েসেনিন (১৮৯৫-১৯৯৫) কে উৎসর্গ করে দ্রষ্টব্য-৫ রেড এন্ড ব্ল্যাক এর সমন্বয়ে নতুন করে জানান দিতে চায় ছোট কাগজের অহংবোধ। অত্যন্ত সতর্ক প্রহরায় যেন শীতের পাতার মতো ঝড়ে পড়ে অযাচিত লেখকরা। মোহাম্মদ সফিউদ্দিন আর চন্দন কৃষ্ণ পালের সাথে চতুর্থ সংখ্যা থেকে কবি মজনু শাহ এসে পড়ে দ্রষ্টব্য পরিবারে। আর দ্রষ্টব্য-৭ এ দ্রষ্টব্য পরিবারে যোগ দেন মাসুদুল হক। আর সকল প্রকার মোহমুক্ত আর নিরন্তর নিরীক্ষায় শিল্পকর্মী তৈরির প্রেষণায় দ্রষ্টব্যভুক্ত হতে থাকে ঢাকা, বগুড়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, যশোর, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ নানা প্রান্তের একদল লেখক। দ্রষ্টব্য-৬ এর কভার খুলে ধরলেই চোখে পড়ে প্রকৃত অর্থে একটি ছোট কাগজের চেহারা। দুই লাইনের মাঝে ধাক্কা খায় যে কথাগুলো সেগুলো হচ্ছে-
“ঘেন্না-মৌলবাদ
সুবিদাবাদ গোয়েবলসবাদ আর
শাদা মুখোশ পড়া ভ-দের প্রতি”
মাত্র ২৪ বছরে ফাঁসির রজ্জুতে আত্মাহুতি দেয়া ৯০ দশকের অসামান্য কবি শামীম কবীর এর সমগ্র সাহিত্যকর্মী নিয়ে একটি প্রকাশনা শামীম কবীর সমগ্র প্রকাশ করতে প্রস্তুতি চলে। একটি আর্থিক সংকট মোকাবিলায় (অগ্রীম গ্রন্থ বিক্রয় প্রকল্প) প্রকল্পটির বিজ্ঞাপন ছেপে দেই দ্রষ্টব্য-৬ এর দ্বিতীয় পাতায়। উল্লেখ করার মতো কোনো সাড়াই পাইনি। যদিও শামীম কবীর সমগ্র প্রকাশ পরিকল্পনা থামিয়ে দিতে পারেনি কোনো সংকট। বরং গত তিনযুগেরও (তৎকালে ১৯৯৮) বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের জগতে যে লোকটি সম্পূর্ণ একা প্রাতিষ্ঠানিক শানানো শিং এর বিপরীতে এক বর্ম তৈরি করে ফেলেছিলেন যিনি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পুরোধা তিনি সুবিমল মিশ্র যিনি প্রকৃত অর্থেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখক- যিনি নিজেই নিজের বই ছাপেন- নিজেই নিজের বই বেচেন- তাঁর প্রতি দৃষ্টি অবনত করি। তাঁর থেকেই যেন পাঠ শিখে দ্রষ্টব্য-৬ এ মুক্তগদ্য ছাপি এই নামে লিটল ম্যাগাজিন ও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ১০০% পরিপূরক। চা এবং চিনি নয়, দেহ এবং রক্ত; কারণ চিনির বিকল্প রয়েছে। আর সুবিমল মিশ্র সংখ্যা তৈরিতে প্রায় দুই বছর জুড়ে সুবিমল পড়ে-পড়িয়ে তাঁর উপর গদ্য তৈরি করা, স্বশরীরে, শম্পামির্জানগরে সুমিবল মিশ্রের আবাসনে থেকে উপলব্ধি করে পরীক্ষিত লেখকদের লেখা সংগ্রহ করে এবং প্রায় বছর জুড়ে টানাপোড়েন, সম্ভাবনা অসম্ভাবনা, আর নানাপ্রকার বিপত্তির বেড়াজাল ভেঙ্গে একটি লিখিত সাক্ষাৎকার (কথা ছিল মুখোমুখি সাক্ষাৎকারটি নেয়া হবে উসকে দেয়ার জন্য) সহ সুবিমলের উপর একটি পুরো সংখ্যা করতে সক্ষম হই। যদিও দীর্ঘ সময়ের মাঠে নানা ঘটনা অপঘটনা অপ্রত্যাশিত-অযাচিত ঘটনা অকাম্য হলেও সুবিমল মিশ্র থেকে সুরূপ-বিরূপ কোনো অনুভূতির স্পর্শে ভিজতে সমর্থ হইনি। দুঃখবোধ বা গ্লানিবোধ কোনোটিই নেই কারণ সময়ের দাবি হিসেবে আমরা কাজটি করেছি। আর এ সংখ্যার প্রচ্ছদ পাতা উল্টোলে যে একছত্র কথা টান টান অনুভূতি ছড়ায় সেগুলো নিম্নরূপ-
আর বিরোধিতার সবগুলো পথে যখন
ওদের বিচরণ শেষ হয়ে পড়ে তখন তাদের
মিথ্যার বেসাতি করা ছাড়া আর কোনো
উপায় থাকে না।
আর মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প আমাদের
কার-ই-বা না জানা আছে।
লিটল ম্যাগাজিন :
নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে
দাঁড় করিয়ে দেয়ার একটি চলমান প্রক্রিয়া
অতঃপর দীর্ঘ সময়ের এক নিস্তব্ধতা। আমরা কি খুব ক্লান্ত ছিলাম? মানুষের জীবনে সময়ের প্রভাব কতটুকু? অথবা কতটুকু হলে মানুষ বিপর্যস্ত হয়? তবে সময়ের সাথে জীবনের গতিপথের পরিবর্তনের একটা যোগসূত্র রয়েছে। যেমন একটি ঘটনাই যদি বলি- সুবিমল মিশ্র সংখ্যা (দ্রষ্টব্য-৭) পুরো দুই বছর যখন ছাপাখানায় যাবে ঠিক তখন আমার চাকরীস্থল পরিবর্তন (ঢাকা প্রত্যাগমণ), ফলে পুরো ছাপার কাজ বগুড়ায় সেরে, মুদ্রিত কাগজ ট্রাকে করে ঢাকা নিয়ে আসা অতঃপর ঢাকাতে বাধাই- এই হচ্ছে দ্রষ্টব্য-৭ এর আত্মপ্রকাশপর্ব। সুতরাং লিটল ম্যাগাজিন কর্মপ্রক্রিয়া কখনও কাউকে ক্লান্ত করে তুললে এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকে বলে আমি মনে করি না। থেমে যেতেই পারে কোনো নিয়মিত প্রকাশনার ছোটকাগজ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ছোটকাগজ ১ বা ২টি বন্ধ হয়ে গেলে (সাময়িক বা চূড়ান্ত) ঐ কাগজের লেখকরা কোথায় দাঁড়াবে বা কী করবে? তিনি কি ছোট কাগজের দায়ভারমুক্ত হয়ে প্রচলিত ধ্যান ধারণায় মিশে যাবেন? তিনি কি দৈনিকের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিবেন? আসলে কি ব্যাপারটা এ রকম? তাহলে কি সকল দায়ভার সম্পাদকের কাঁধে চাপিয়ে লেখক দায়মুক্ত থেকে যাবেন? আমি মনে করি মোটেই না। কারণ ছোট কাগজের প্রবাহমান স্রোতধারায় লেখক ও সম্পাদকের সমানই দায় থেকে যায়। আর এ কথাও অনস্বীকার্য, যে কোনো সময়েই লিটল ম্যাগাজিনের একটি প্রবাহমান ধারা অব্যাহত থাকেই। সুতরাং কোনো লেখকের যদি চেতনাচ্যুতি ঘটে তাহলে ধরে নিতে হবে ঐ লেখকের এক ধরনের মোহগ্রস্ততারই বিকাশপর্বের উত্থান কিংবা চেতনা বিলোপের মাধ্যমে গড্ডালিকা স্রোতের বহমানের একটি প্রয়াস। এজন্যেই কামরুজ্জামান কামুর কিংবা টোকন ঠাকুরের মত লেখকদের ছিটকে পড়া যেমনি ক্ষতিগ্রস্ত করে না লিটল ম্যাগাজিনকে তেমনি মজনু শাহ কিংবা মাসুদুল হককে হারানোর (প্রাপ্তির প্রত্যাশা তারপরও থেকে যায়) বেদনাবোধ থাকলেও কোনো গ্লানিবোধ কাজ করে না। কিসের গ্লানি? কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকই পুরো জগৎ জুড়ে দায়িত্ব পালনের জন্য আসে না। প্রয়োজন সম্পাদক কিংবা লেখকদের স্থিতধি পর্যবেক্ষণ। নদীর জল যেমনি গতিষ্মান থাকবেই এমন কোনো কথা নেই, আবার পাহাড় থেকে উৎসারিত জলস্রোত মন্থর জলপ্রবাহকে গতিষ্মান করে দেয়। তেমনি লিটল ম্যাগাজিনের প্রবাহমান স্রোতে কোনো কাগজও থেমে যেতে পারে, এমনকি বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। দেখার বিষয় হচ্ছে ঐ কাগজটি তার চেতনাবোধ থেকে দূরে সরে গেলো কিনা? এক্ষেত্রে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া যা কিছু কালব্যাপী থেমে থাকতে পারাটাকে অসহ্য মনে হওয়ার থেকে লেখক-সম্পাদকের মানসিকতা থেকে শুদ্ধ বা ঘনীভূত চেতনার বিনাশ বা বিচ্যুতি তার চেয়ে অসহ্য মনে হতে পারে। আর দীর্ঘ সময়ের নিস্তব্ধতার মাঝে যে সময়ের প্রবাহমানতা থাকে সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্বের কারণে কিংবা খল চরিত্রের দ্বারা জারিত-বিজারিত হয়ে লেখক-সম্পাদকের মধ্যে যদি কোথাও বিচ্যুতির রেখাংশ চোখে পড়ে তারও পর্যবেক্ষণের ব্যাপার রয়েছে। কারও কোনো একটি লেখা হঠাৎ করে কোনো দৈনিকেও যদি ছাপা হয়ে যেতে দেখা যায় তাতেও বিচলিত বা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্তে উপণীত হওয়া ঠিক হবে না- দেখতে হবে অতঃপর তার ক্রিয়াকর্মের ইতিবৃত্ত। এক্ষেত্রে ব্ল্যাকমেইলিং করার কারণটিকেও অবজ্ঞা করার কারণ থাকতে পারে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো কোনো বিচ্যুতি দেখে তার চেতনার বিনাশ বা আদর্শিক মানদ- থেকে বিচ্যুত ঘটেছে তা না ভেবে তার বা তাদের উপর বিচক্ষণ দৃষ্টি ফেলে সার্চ করার প্রয়োজন আবশ্যক মনে করি। অতঃপর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তিনি কি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার অধিকার রাখেন কিংবা তিনি কি লিটল ম্যাগাজিনে আর লিখতে পারে? দশ ছত্র কাব্য-গদ্য করে কোনো বিষয় নিয়ে চূড়ান্ত তো নয়ই বরং তার আরও কিছুকাল নিজেকে নিয়েই পর্যবেক্ষণ করা উচিৎ। কারণ সময়ের সাথে যেহেতু মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল সেক্ষেত্রে আগামীকাল তিনি নিজেকে নিয়ে কনফিউজড থাকা উচিত। তারপর তো অন্য কাউকে নিয়ে বিতর্কে নামা। আর ইহা সত্য যে লিখতে থাকেন, কাগজ করতে থাকেন এবং সময়ের স্রোতে আপনি লিটল ম্যাগাজিনের উপযুক্ত হয়েছেন কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আর আমি কামরুল হুদা পথিককে যখন পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ-নিরীক্ষণপূর্বক যদি এমতঃ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন তাহলে উনাকে বাতিল করার স্পর্ধা অবশ্যই আপনার রয়েছে। রয়েছে কামরুল হুদা পথিকেরও। তাইতো দ্রষ্টব্য-৮ জানান দিতে এলো দ্রষ্টব্র বিচ্যুতি হয়নি- কোনো কোনো লেখক বাতিল করেছি, অনেকে বাদ দিয়েছেন-কিন্তু অনেকেতো এসেছেনও। এক মজনু শাহকে নিয়ে কোনো প্রকার আফসোস করতে আমি নারাজ কারণ নতুন নাভিল মানদার তো এসেছেন। সুতরাং এ যাওয়া-আসার ঘটনা কালান্তর স্রোতে বহমান থাকবেই এবং এ নিয়েই নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে সক্রিয় রাখার এক দ্যুতিময় জগৎ থেকে দ্রষ্টব্য বেরিয়েছে এবং বেরুবে অথবা হয়তো বেরুবে।
লিটল ম্যাগাজিন :
নিজেকে নিজের বিরুদ্ধে
দাঁড় করিয়ে দেয়ার একটি চলমান প্রক্রিয়া