এটি প্রকৃতপক্ষেই সুবিমল মিশ্রের সাথে আমার একটি কথোপকথন হওয়ার কথা ছিল, যেখানে সহযাত্রী শাহ্ মোহাম্মদ আলম, মজনু শাহ্ এবং মাসুদুল হক-এর সহযোগিতায় সুবিমল মিশ্রের এ যাবৎকালে যতগুলো সাক্ষাৎকারের নামে একই বিষয়াবৃত্তির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে- সবগুলোকে অতিক্রমের একটি চেষ্টা থাকবে। অর্থাৎ সুবিমল মিশ্রের স্তুতি বা প্রসস্থি মূল উদ্দেশ্য না হয়ে তাঁকে, তাঁর লেখা আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্রকে ব্যবচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে তাঁকে চরমভাবে উসকে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি ছিল। সুবিমল মিশ্র হয়তো ক্ষিপ্ত হয়ে বৈঠক ত্যাগ করবেন কিন্তু আমি তাঁর পিছু ছাড়বো না এবং এভাবেই অনেকগুলো বৈঠকের কথোপকথনের সমষ্টি হয়ে উঠবে এই সাক্ষাৎকার পর্ব। কিন্তু সেমতে সুবিমল মিশ্রের সাথে কথোপকথন-পর্ব সম্পাদনকার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে শেষমেষ এটি হয়ে পড়ে সুবিমল মিশ্রের একটি লিখিত সাক্ষাৎকার। ১৯৯৬ হতে ১৯৯৮ প্রায় ২ বছর জুড়ে এ সাক্ষাৎকারটি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঝামেলা গিয়েছে। বার কয়েক সুবিমলের মুখোমুখি টেপরেকর্ডার নিয়ে বসেও কাজ করতে পারিনি। মাঝখানে সাক্ষাৎকারের প্রশ্নগুলো দু-পক্ষেই হারিয়ে যাওয়ায় কাজটি হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে পড়ে। আবার এক সময় সুবিমল মিশ্র প্রশ্নগুলো উদ্ধার করতে সক্ষম হলে উদ্যোগটি বাস্তবে রূপ নেয়। কিন্তু সময় তখন এত চেপে আসে যে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ থাকে না। তাই সুবিমল মিশ্রকে বাজিয়ে নেয়া বা উসকে দেয়া অর্থাৎ তাঁর চরম রূপ প্রত্যক্ষ করা কোনোটাই সম্ভব হয় না। তাই এই সাক্ষাৎকার পাঠে সুবিমল মিশ্র আমার বেশ কিছু প্রশ্ন ধরতে পারেননি বা এরিয়ে গেছেন বলেই মনে হবে। কিন্তু আমি তাঁর পাঠানো সবটুকুই হুবহু ছেপে দিয়েছি। সময় ও ভৌগোলিক দূরত্ব কাজটিকে শেষাবধি একটি অসম্পূর্ণ কাজেই স্থিতি দিয়েছে। পাঠক, সে অক্ষমতা স্বীকার করেই এই সাক্ষাৎকার পত্রস্থ হল এই ভেবে যে- যদি সুবিমল মিশ্রকে আরও একটু আবিষ্কারের সুযোগ থাকে।‘যারা শুধু হেরে যাওয়াকে ভয় পায়, জিতে যাওয়াকে নয়, আমি সেই টিপিক্যাল লেখকদের দলে নই...’ ‘প্রত্যেকেই সফলতার খোঁজ করে, আমি খোঁজ করি অন্য কিছুর। আমার জীবনের প্রধান ব্যাপার হল হয়ে ওঠা, হয়ে ওঠার চেষ্টা। এই ‘চেষ্টা’ শব্দটির ওপর আমি বিশেষভাবে জোর দিতে চাই। জীবনের শেষক্ষণটি পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় থাকা, সম্পূর্ণভাবে দায়িত্ববান হওয়া, নিরন্তর বিরূপ সমালোচনা-কোনো কিছু হয়নি, কোনো কিছু হচ্ছে না সুবিমল এক ধরনের স্ট্যান্ট দেওয়া ছাড়া- এই ধরণের মতামতের ঝুঁকি নেওয়া এবং অবশ্যই স্থির লক্ষ্যে নিজের কাজ করে যাওয়া। নিজেকে ভগবান, ভাগ্য কিংবা এ ধরনের কারো হাতে তুলে দেওয়া এক ধরনের কাপুরুষতা বলে আমি মনে করি। আর কাপুরুষতা আমি আদৌ পছন্দ করি না। সফলতা এলে আমি ভয় পাই। কারণ নতুন কিছু করলে সফলতা সঙ্গে সঙ্গে আসে না। আমি যদি সফলতা পাই তার মানে হল আমি এমন কিছু করছি যা তত নতুন নয়।’
পথিক : বিচ্ছিন্নভাবেই আলোচনা শুরু করা যাক। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে অনেকটুকু পথ তো এগুলেন। আর ঠিক এ সময়ে যদি আপনাকে সার্বিক দিক থেকেই প্রশ্ন করি কেমন আছেন?- কি বলবেন?
সুবিমল মিশ্র : জানি না ঠিক কেমন আছি। কারো পক্ষে জানাও সম্ভব নয়। কেউ যদি বলে জানি আমি কেমন আছি তাহলে ধরে নিতে হবে তার সবকিছুই জানা হয়ে গেছে। কেমন আছি সেটা জানতে চাওয়ার চেষ্টাই তো গোটা একটা জীবন-একটা মানুষের সবটা কর্মকা-ের মূল। একটা লোক ঠিক কেমন আছে সেটা জানার প্রচেষ্টাই সে করে যায় গোটাটা জীবন ধরে, তার সব কর্মকা-ের ভেতর দিয়ে, আর কেউই বোধ হয়, আমার মনে হয় তা ঠিক হিসেব করে উঠতে পারে না। তবে আপনি যা জানতে চাইছেন তার কিছুটা স্পষ্টতা আমার ডাইরি জাতীয় লেখায় আছে-
...................................................................................................................................................................
জীবনটা আমার, ব্যক্তিগতভাবে, বলতে গেলে, রাত্রিময়; আর এখন সেই রাত্রির শেষ প্রহর। বাঁ-হাতে সিগারেট ধরা আছে, ধরা থাকে সব সময়, আমাদের কোয়ার্টার বরাবর কারখানার গেটের সামনে রাত-পাহারাদারদের লাঠি ঠোকার দূরাগত আওয়াজ অস্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমি। হাসপাতালে থাকতে থাকতে ঋত্বিক কুমার ঘটকও এরকম শুনতে পেতেন, শুনেছি। আর নয়, এসব এখানেই শেষ করি। শুধু সব শেষে একটা কথা, বছর-দেড়েক ধরে যে লেখাটি নিয়ে আমার ঘষাঘষি, মানে চলছে, মাথায় ক্যাথিয়াকার, জর্জ পেরেক, আর আলেকজান্দার-ভন-ক্লুট-তাতে একটা উদ্ধৃতি যোজনা দেওয়ার ইচ্ছে, যেটি ব্রেখট সাহেবের, মৃত্যুর আগে পার্টির এক সোজা- মাপের কর্তাব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে, এরকম : ‘ওদের বল যে তুমি আমাকে প্রতিপদে একটা সমস্যা হিসেবে দেখেছ; আর তোমাদের সমস্যা হয়েই লোকটি, আমি, থাকতে চাই।’
...................................................................................................................................................................
পথিক : আপনি আমাকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমার উপর যারা লিখবে তাদের- আমার, আমার সাহিত্যের, আমার আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে যা খুশি লিখুক- এ স্বাধীনতা সম্পূর্ণ লেখকের।’ আপনার পাঠক সম্পর্কেও অভিমতটি অনেকটা এরকম। কিন্তু আপনার যে কটি সাক্ষাৎকার পড়ার সুযোগ হয়েছে- কোথাও কিন্তু সেরকমটি আমি দেখতে পাইনি। অর্থাৎ কেউ যেন আপনাকে বাজিয়ে দেখতে চাইছে না। আপনার কি কখনও এরকম মনে হয়েছে? হলে কেন?
সুবিমল মিশ্র : বাজিয়ে দেখা বলতে ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন পরিষ্কার করে জানালে ভালো হত। নানা মানুষ নানা সময়ে নানা রকম প্রশ্ন করেছে। আমি আমার সাধ্যমত উত্তর দিয়েছি। প্রশ্নকারীকেও সবসময় সব ধরনের স্বাধীনতা দেওয়া থাকে, স্পষ্টতই বলা থাকে, যত অপ্রিয় প্রসঙ্গই থাক না কেন আমি আমার সাধ্যমত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। তারা যেসব প্রশ্ন করেছেন তার উত্তরই দিয়েছি, দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আসলে যে যেভাবে ভজনা করে সে সেভাবে পায়।
পথিক : আপনার যতটুকু কাছে আসা, তাতো আপনার সাথে আমার চিঠি-পত্তর লিখে-পেয়েই (বাকিটা আপনার লেখা পড়তে পড়তে)। তাও বলতে পারেন বছর দুই-এর একটা স্বল্প সময়ের। মনে পড়ে আমি যখন আপনাকে চিঠি লিখি তখন এক ধরণের ভয়ই ছিল আপনার উত্তরপত্রে আপনাকে কেমন দেখবো তা ভেবে। (তারপরতো আমার সকল ভাবনাকে পিছনে ফেলে অসম্ভব এক ভালোবাসার মানুষ পেয়ে গেলাম চিঠির প্রতিটি শব্দে)। ধীমান দাশ গুপ্তও এ কথাটিই পরিষ্কার করেছেন তার বিভিন্ন আলোচনায়। অর্থাৎ ব্যক্তি সুবিমল এবং লেখক সুবিমলের মধ্যে রয়েছে উল্টো চরিত্র। তাহলে আপনি কি মনে করেন লেখাটা লেখকের চরিত্র থেকে আলাদা? অথবা লেখকের লেখার মধ্যে লেখকের সবটুকুকে খুঁজে পাবার চেষ্টা উচিৎ নয়?
সুবিমল মিশ্র : একটিা মানুষের মধ্যে কত যে অন্য-মানুষ লুকিয়ে থাকে, কত ভিন্ন ভিন্ন মেরুও- তার দোষ-গুণ, ভালবাসা-ঘৃণা, দৃঢ়তা-দুর্বলতা সব মিলিয়েই সে একটা গোটা মানুষ, সবচেয়ে জটিল জীব। এটা বুঝতে না পারলে মানুষকে বোঝা সম্ভব নয়। আমাকে যাঁরা ভালোবাসেন তাঁরা হয়ত আমার কোনো কোনো দিক বড় করে দেখেন, এটা তাদের মহানুভবতা, এ নিয়ে আমার সংকোচও আছে। আমি যা নই তা ‘উপরি’ হিসেবে পেলে নিজেকে খুব সুবিধাবাদী মনে হয়। তবে হ্যাঁ, শুধুমাত্র লেখক হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই আমি গৃহীত হতে চাই। এই ‘বুর্জোয়া-ভাইসটি’ আমি বজায় রাখার চেষ্টা করি (ভাল করেই জানি এটা বুর্জোয়া ভাইস-ই), যদিও তার সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কখনও কখনও আমি এক ধরণের দূরত্ব বজায় রাখি, রেখে চলি-এমনকি নিজের সঙ্গেও (এতে নিজেকে বিচার করার সুবিধা হয়)। আবার ব্যক্তিগতভাবে কারোর প্রতি খারাপ ব্যবহার করা আমি পছন্দ করি না, আবার কখনও কখনও করি না যে এমনও নয়। যদিও আদর্শগতভাবে আক্রান্ত হলে তাকে আমি চরম প্রতি আক্রমণ করে থাকি এবং অবশ্যই আমার শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। অনেকেই ব্যাপারটা ধরতে না পেরে গুলিয়ে ফেলেন।
যখন কাউকে চিঠি লিখি তখন তাৎক্ষণিক অনুভূতি আমার মধ্যে কাজ করে, সেই সময়ের অনুভবটুকুতে আমি সৎ থাকি, অকপট থাকি। যেহেতু আমি ডাইনামিক মানুষ, থাকতে চাই, পরে সেইসব চিঠিগুলির ব্যাখ্যা কি হবে এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না, ভেবে দেখারও প্রয়োজনবোধ করি না।
পথিক : আপনার লেখা যা পড়ার সুযোগ পেয়েছি ৬৮-৬৯ এর লেখা থেকেই। অর্থাৎ ৬০ এর দশক থেকেই আপনি একাধারে লিটল ম্যাগাজিনের লোক এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধী। লিটল ম্যাগাজিন এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন দুটোতো অবশ্যই পরিপূরক। তাহলে আপনি কি লিখতে এসে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হলেন, না প্রতিষ্ঠানবিরোধী হয়ে লিখতে এলেন? আসলে আমি আপনার লেখালেখির শুরুর দিকটা জানতে চাচ্ছি।
সুবিমল মিশ্র : লিটল ম্যাগাজিন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা দুটো ‘অবশ্যই পরিপূরক’ এটা নিয়ে ভাববার ব্যাপার আছে। মোটামুটি ভাবে একটা লিটল ম্যাগাজিন করে ফেলা যায়, লিটল-ম্যাগাজিন জাতীয় কাগজতো বটেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটল ম্যাগাজিন অনেক অনেক বেশি অন্যতর ব্যাপার। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা জীবনদর্শন। যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী তার কাছে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা টোট্যাল ব্যাপার। প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা এবং একটা প্যারালাল ধারা তৈরির দিকে তার লক্ষ্য থাকে, যে ধারার সাহিত্য মানুষকে শুধুমাত্র বিনোদন দেবে না, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কেও সচেতন করবে, প্রাথমিকভাবে তাকে পাল্টানোর একটা প্রচেষ্টা তার মধ্যে থাকবে। (যদিও পুরোপুরি পাল্টানো যায় কি না সে প্রশ্ন থেকেই গেছে, কেননা তথাকথিত মার্কসবাদীরা যারা প্রতিষ্ঠানকে পাটি ফেলার ডাক দিত কালে কালে দেখা গেল প্রতিষ্ঠানকে পাল্টাতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে তারাই এক একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। প্রতিষ্ঠান বহুরূপী, স্থান কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারা এবং মনোভূমির পরিবর্তন ঘটে, এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ আছে- ভবিষ্যতে আমি তা করবোও। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র অন্যরকম। কিছু অন্যধারার লেখা, অধিকাংশ পরীক্ষামূলক লেখা ছাপিয়েই একটা মোটামুটি গোছের লিটল ম্যাগাজিন করে ফেলা যায়। যেগুলো চোখের সামনে দেখি তার অধিকাংশ ঐ রকম লিটল ম্যাগাজিন বা লিটল ম্যাগাজিন জাতীয় হয়ে ওঠার চেষ্টায় আছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মূল যে সক্রিয় জীবন দর্শন, যে জঙ্গীপনা থাকলে প্রতিষ্ঠান ভয় পায় তা তথাকথিত লিটল ম্যাগাজিনে থাকে না। এটা সাধারণভাবে লক্ষ্য করা যায়, প্রতিষ্ঠান এই জাতীয় লিটল ম্যাগাজিনগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করে, রিভিয়্যু করে পিঠ চাপড়ে দেয়, প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন দিয়ে আর্থিক সাহায্য করে তাকে বাঁচিয়ে রাখে-কেননা তারা বুঝতে পারে যে এইসব লিটল ম্যাগাজিন ভয়ঙ্কর, তা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকে বিপন্ন করার জন্যেই জন্ম নেয় (প্রতিষ্ঠান বলতে এখানে শুধুমাত্র কয়েকটি বাণিজ্যিক কাগজকে বোঝানো হচ্ছে না, তার অবস্থিতি ব্যাপক, আমাদের মধ্যে যে মধ্যবিত্তীয় সুবিধাবাদিতা, গুছিয়ে নেবার প্রবণতা-যার মধ্যে দেখা যায় আগারও খাবো তলারও কুড়াবো জাতীয় মানসিকতা-তাও কিন্তু একটি বিরাট প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতা সজ্ঞাত।
খুব সংক্ষেপে বললে প্রথমে লিটল ম্যাগাজিন হতে হবে এবং নানা প্রাকটিসের মধ্য দিয়ে, নানা স্তর পরম্পরা পেরিয়ে তা প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিন্যাসের দিকে এগুতে পারে, যদি তার সত্যিকারের তাগিদ থাকে, সদিচ্ছা থাকে সেই ধরনের THOUGHT PROCESS থাকে। খুব সাধারণভাবে বললে আমাদের এক-আধটা লিটল ম্যাগাজিন আছে, কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন-জাতীয় কাগজ আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটল ম্যাগাজিন একটিও নেই। সম্প্রতি বেরুল অ-য়ে অজগর কাগজটি। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার শ্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে- দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়। আর একটা কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে ছোটো আকারের কাগজ হলেই তা লিটল ম্যাগাজিন হবে, লিটল ম্যাগাজিন আকারকে বোঝায় না বোঝায় চরিত্রকে।
বিরোধিতার একটা ব্যাপার সম্ভবত আমার রক্তে ছিল, কোনোকিছুই বিনা বিচারে গ্রহণ করতে পারতাম না। প্রচলিত ধারার গল্প-উপন্যাস, যেগুলো সাধারণত ব্যবসায়িক, আধা-ব্যবসায়িক পত্রিকায় ছাপা হয়, যেগুলো বই হিসেবে বেরিয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে- তা পড়ে কখনও আমার মন ভরতো না। কোথায় যেন একটা অতৃপ্তির চোরাটান আমার ভেতরে ছিল প্রথম থেকেই। তার জন্য বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে বা তথাকথিত লিটল ম্যাগাজিন অথবা আধা-লিটল ম্যাগাজিন জাতীয় পত্রিকাগুলিতে লেখা পাঠানোর ইচ্ছে বা চাড় কোনোদিনই আমি অনুভব করিনি। ‘দেশ’ ‘অমৃত’ তো ছিলই, তখন বিভিন্ন পর্যায়ে ছিল ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা, ‘কলকাতা’, ‘স্বারস্বত’- কিছু পরে সমরেশ বসুর সম্পাদিত ‘মহানগর’। তাই চেষ্টা করেছিলাম, প্রথম থেকেই নিজস্ব ধরনের একটা কাগজ গড়ে তুলতে যাতে বিরোধী ধরনের, অন্যতর চিন্তার লেখাগুলি ছাপা যেতে পারে। এই ব্যাপারে যিনি আমাকে নীরবে হলেও সমর্থন করে ছিলেন তিনি ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকার শ্রদ্ধেয় সমর সেন। কিন্তু তিনি তখন আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে বেশি চিন্তিত। আর একজন যাঁর কথা আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি তিনি সদ্য গ্রীস দেশ প্রত্যাগত দীপক মজুমদার। মনে আছে তাঁর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তিনি আমার নাঙা হাড় জেগে উঠছে বইটি পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন, উচ্চকিত প্রশংসা করেছিলেন বইটির টাইপ-সেটিং কভারটির। তিনি বলেছিলেন পুর্ণেন্দুকে (পত্রী) তোমার বইটি একবার দেখিয়ে এসো। তিনি তখন কৃত্তিবাস (নব পর্যায়ে) পত্রিকার পুস্তক সমালোচনা দেখতেন সম্ভভত। কিন্তু আমার মধ্যে একটা অনীহা ছিল। কৃত্তিবাসে সমালোচনার জন্য অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো বই দিই নি। দীপক মজুমদার তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় এবং অন্যত্র কোথাও কোথাও আমার প্রশংসা করেছেন যা আমাকে অন্য ধরনের লেখায় উৎসাহ জুগিয়েছিল। আমার ‘হারাণ মাঝি’ গল্পটি ‘পরিচয়’ থেকে প্রত্যাখ্যাত হবার পর ছাপিয়ে দিয়েছিলেন কবিতাপত্রের সম্পাদক পবিত্র মুখোপাধ্যায়। এই সময় আমাকে লেখায় উৎসাহ দিয়েছিলেন তখনকার দিনের বেশ নামকরা কবি প্রভাত চৌধুরী। ‘হারান মাঝি’ প্রকাশের পর প্রথম সমালোচনাটি করেছিলেন তরুণ সমালোচক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। এঁদের প্রত্যেকের কাছেই লেখালেখির ব্যাপারে আমি বিশেষভাবে ঋণী। আমার প্রথমদিকের গল্পগুলি ছাপা হয়েছিল নকুল মৈত্র এবং ভরত সিংহ সম্পাদিত ‘একাল’ পত্রিকায়। আমার প্রথম বই হারাণ মাঝি-র প্রকাশক-ঠিকানা ছিল ‘একাল’ এর ঠিকানা-ই। আস্তে আস্তে আমার লেখায় জঙ্গীপনা এবং সব কিছুকে ডোন্ট-কেয়ার করার প্রবণতা দেখা দিতে থাকে এবং প্রচলিত সাহিত্য-জগত আমাকে প্রথমে হয়েছিল অমৃত পত্রিকাকে কেন্দ্র করে, আমি সরাসরি অমৃত পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা দিতে অস্বীকার করার সূত্র ধরেই। তখন কবি অনন্য রায় প্রায়ই আমার বাড়িতে আসতেন, আসতেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও। তাঁরা আমাকে উৎসাহ দিতেন, অনন্য তাঁদের ‘স্থানাঙ্ক নির্ণয়’ পত্রিকায় ছাপানোর জন্যে ‘উট’ গল্পটি নিয়ে গিয়েছিলেন। নকশাল কবি দ্রোণাচার্য ঘোষ মাঝে মাঝে আমার চৌতলার বাসায় রাত্রিতে আশ্রয় নিতেন, তিনি একটি কবিতা পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন তখন। কবি সুকোমল রায় চৌধুরীও আমাকে প্রেরণা দিতেন। প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন, আমার প্রথম ইন্টারভ্যু ছাপিয়েছিলেন, পরে তিনি পুরোপুরি নকশাল হয়ে যান। আর লেখালেখি প্রথম থেকেই আমার লেখায় উৎসাহদাতা ছিলেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অজয় দে। প্রতি রবিবার আমার বাড়িতে আড্ডা বসত, সেখানে তাঁরা আসতেন, সেখানেই প্রথম পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা হয়, যে পত্রিকাটির নাম দিয়েছিলাম, ‘এ্যাংকিলোসার’, পরবর্তীকালে মূলত কল্যাণদার সহায়তায় ও আর্থিক সাহায্যে ‘বিজ্ঞাপন’ পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। এই সবের সঙ্গে ছিলেন কবি মনোজ নন্দী এবং গল্পকার শচীন দাস।
এসবের মধ্যে একজনের নামই বিশেষভাবে করতে হয় তিনি বন্ধুবর রবিন ঘোষ। তিনি প্রথম থেকেই আমার লেখার অনুরাগী, ‘হারাণ মাঝি’ প্রকাশের জন্য তিনি সেই যুগে আমাকে একশ টাকা দিয়েছিলেন। পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমি নিজের নাম দিতাম না, আমি লিখতাম ‘অজেয় গুপ্ত’ এই ছদ্মনামে। পত্রিকার সম্পাদক করেছিলাম রবিনকেই। পরবর্তীকালে নানা মতান্তর সত্ত্বেও রবিনই এখনও পর্যন্ত আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে থেকে গেছেন।
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মূল দীক্ষা আমি পেয়েছিলাম শ্রদ্ধেয় দীপেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। তিনি দুর্গাপুর ব্রিজের অপরপ্রান্ত নিউ আলিপুরে মায়া ব্যানার্জীর বাড়িতে থাকতেন। আমি থাকতাম দুর্গাপুর ব্রিজের এপারে দুর্গাপুর লেনে। মাঝে মাঝেই দেখা হতো, তিনি খুব কম কথা বলতেন। তিনি আমার গোটা দুয়েক গল্প পরিচয় পত্রিকায় নিয়ে গিয়ে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক (ছাত্রদের পরিচালিত পত্রিকা, সম্ভবত নাম ছিল একদা) গৃহীত সাক্ষাৎকারটির খসড়া কপি আমাকে শুনিয়েছিলেন, সংযোজন বিয়োজনে আমার পরামর্শও নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তখন বিশেষভাবেই ‘কালান্তর’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, রাজনীতি ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। যদিও আমি তাঁকে অন্য ধারার লেখক হিসেবে বিশেষভাবে সম্মান দিতাম। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে তিনি মূলত এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতেন। তাঁর আনন্দবাজার বিরোধিতা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। ঐ সাক্ষাৎকারটির অনেক অংশ আমি আমার লেখায় হুবহু ভাষাশুদ্ধই ব্যবহার করেছি। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ব্যাপারে তিনি ছিলেন আমার শিক্ষাগুরু কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা যে একটা টোট্যাল ব্যাপার, একটা জীবন দর্শন, নিজেকে বিপন্ন করে একটা বিশেষ সক্রিয়তা-সেটা অনেক পরে আস্তে আস্তে আমি অনুভব করতে থাকি। একদিনে কোনো কিছুই হয়নি, সমস্ত কিছুই ধীরে ধীরে আমার লেখালেখির, জীবনচর্যার ভেতর থেকেই উঠে এসেছে, উঠে আসছে। সংক্ষেপে বললে লিখতে লিখতেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দর্শন আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে, আমি একদিনে প্রতিষ্ঠান বিরোধী হয়ে উঠিনি। এই সময়েই বা এর কিছুদিন আগে থেকেই কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে। তিনি তখন ‘সাউথ পয়েন্ট’ স্কুলে পড়াতেন। আমাকে ছাত্রের মতই অনেক কিছুই শিখিয়েছিলেন। লেখালেখিতে যে মনন চর্যা, প্রতিষ্ঠান বিরোধী না হয়েও লেখায় যে অন্যতর মাত্রা আনা যায়, প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে অন্যতর ভাবে লেখা যায় এ দীক্ষা আমি তাঁর কাছেই পাই। পরবর্তীকালে মার্কসবাদী আখ্যাত হওয়ায় তিনি আমাকে ততটা পছন্দ করতেন না কিন্তু আমার প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অকৃত্রিম। এর কিছুদিন বাদে অমিয়ভূষণ মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, এঁরা দুজনেই অন্যধারার লেখক হিসেবে আমাকে বিশেষ উৎসাহিত করেন। কমলকুমার ও অমিয়ভূষণের অনেকগুলি চিঠিও আমার কাছে ছিল কিন্তু আমার যা স্বভাব কালে কালে সেগুলো হারিয়ে ফেলেছি। এঁদের দুজনের দুটি চিঠি মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল সে দুটির চিহ্ন এখন আমি অবশিষ্ট হিসেবে খুঁজে পাই।
ঋত্বিক কুমার ঘটকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল এর অনেক আগে, যখন আমি ভবানীপুরে ২নং রূপনারায়ণ মুখার্জী লেনে থাকতাম তখন। ওখানে ইন্দিরা সিনেমার উল্টোদিকে রমেশ মিত্র লেনে টিন মাথায় দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখেছি আমি। সে সব অনেক কথা এঁর কাছেও আমি ঋণী, বিশেষভাবেই ঋণী।
পথিক : যেহেতু আপনি শুরু থেকেই অর্থাৎ ৬০ এর দশকে থেকেই ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট। আপনি কি মনে করেন ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে’ একটি আন্দোলনে দাঁড় করাতে পেরেছেন? যদি কেউ কেউ এটাকে আনন্দবাজারী বা সমচরিত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপক্ষে একক চিৎকার বলে অভিযোগ করে তাহলে তার জবাব আপনি কিভাবে দিবেন?
সুবিমল মিশ্র : আমার কাছে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো ‘আন্দোলন’ নয়, একটা জীবনপদ্ধতি। তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে আন্দোলন করে ‘দাঁড়’ করাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। কোনো কিছুকে দাঁড় করানো অর্থই হচ্ছে তাকে প্রতিষ্ঠিত করা, প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানবিরোধি বা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলে কিছু হতে পারে না। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা যে জীবনপদ্ধতি তা এক বিশেষ চিন্তন, পরীক্ষা করতে করতে যাওয়া, সর্বদা নিজের উপর চোখ রাখতে রাখতে, চোখ কান খোলা রেখে, যাওয়াটাই-চরাটাই আসল কথা, কোথাও আটকে যাওয়া নয়, আটকে গেলেই তা প্রতিষ্ঠিত হতে চাইবে, শ্যাওলা জমবে, জমবে আগাছা, কিছু একটা হতে চাইবে তা। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এক নিরন্তর পথ চলার ফসল, বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন বাঁক থাকে, থাকতে পারে, কিন্তু তার একটা স্রোতও থাকে, গতি,-কোথায় তার উৎস আর কোথায় তার গন্তব্য সেটা কিন্তু স্থির হয় তার পথ চলা থেকেই-আগের থেকে কোনো কিছু স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে নয়।
শুধুমাত্র আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে তা চিৎকার হবে কেন, প্রতিষ্ঠিত যে কোনো চড়বিৎ, যা গতিরুদ্ধ করে, মানুষের নিরন্তর-চিন্তা-স্রোতকে অস্বীকার করে, তাই তো প্রতিষ্ঠান। কখনও কখনও কোনো তাৎক্ষণিক কারণে তা আনন্দবাজার বা সমজাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে চিৎকার বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তা-ই শুধু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নয়। ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজ, সাহিত্য- যা কিছু মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পথের অন্তরায়- প্রতিষ্ঠিত সেসব কিছুর বিরুদ্ধেই তার প্রতিবাদ। তবে একটা কথা স্পষ্ট বলে রাখা ভাল, বিশেষ কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান যখন প্ররোচনা দেয়- এই রকমই লিখতে হবে, এই রকম হলে তা সাহিত্য হবে- আর তারাই হল আগ-মার্কা সাহিত্যিক- আমরা যাদের প্রোমোট করি... এইসব ‘বেদবাক্য’ যখন এই নিরক্ষর প্রধান উপ-মহাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠতে তাঁকে তখন তার বিরুদ্ধে চিৎকার তো করতেই হয়, প্রতিবাদ শুধু নয়, নিজেকে বিপন্ন করে প্রতিরোধও।
অভিজ্ঞতায় জানি শাপলাকে বাড়তে দিলে তা গোটা পুকুরটাকেই ঢেকে ফেলে। তাই আগাছা নির্মূল হোক এই চাওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তার জন্যে হাত লাগানোও জরুরি। পাঠক হিসেবে এই ‘সক্রিয় প্রতিবাদের’ দায়িত্ব থেকেই এই প্রতিবেদন, যা মিনমিনে প্রতিবাদ মাত্র নয়, সক্রিয় বিরোধিতাও। তার বাড়াবাড়ির দিকটি সম্পর্কে আমরা সচেতন, কিন্তু সক্রিয়তার জন্যে এটা আমাদের করতেই হয়। আসলে ঠেক-বাজরা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নাম করে একটা ‘দলপাকাতে’ চাইছে, প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির কালোবাজারীদের ঢঙে। নিজেদের দলের হলে তাদের কাছে সব ভালো, সে মহত্তর, আর দলের না হলে তার সব কাজ বাজে। দলপাকানোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে দলের বাইরের সবাইকে মিথ্যা-কুৎসা দিয়ে তাদের চরিত্র হনন করা, অপর পক্ষে দলের জন্যে ‘মাইলেজ’ তোলা। (সুবিমল মিশ্র বলেন, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রত্যয়ে ‘একত্র হওয়া’ আর ‘দলপাকানো’ এক জিনিস নয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার মধ্যে প্রত্যেকের নিজস্ব স্বাধীনতা ১০০ ভাগই বজায় থাকে, এমনকি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতাও। মূল প্রত্যয়ে স্থির থেকে নিজেদের মধ্যে ভিন্ন মত পোষণ করাও যায়। ‘দল’ সবাইকে স্টিম রোলারে চেপে এক লেবেলে আনতে চায়, দলের কথাই সেখানে সবার কথা, কারোর ভিন্নমত ভিন্নভাবনা পোষণ করার অবকাশ থাকে না।)
পথিক : যেমন আপনাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে এত যে লিটল ম্যাগাজিন, লিটল ম্যাগাজিন করেন, লিটল ম্যাগাজিন কোনটি? তাহলে আপনি কি নাম করবেন? এ প্রেক্ষিতে লিটল ম্যাগাজিনের একটি কংক্রিট সংজ্ঞা/ব্যাখ্যা কি আমাদের দিবেন?
সুবিমল মিশ্র : লিটল ম্যগাাজিনের সংখ্যাতো আঙুলে গোনা যায়, তবে সেগুলোকে প্রায় লিটল ম্যাগাজিন বা লিটলম্যাগাজিনের কাছাকাছি বা লিটল ম্যাগাজিন হয়ে উঠতে চাওয়া এক ধরনের কাগজ বলা যেতে পারে। তবে আমার পছন্দের তেমন কোনো কাগজ নেই যাকে এই মুহূর্তে আমি প্রাণ খুলে প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন বলতে পারি। আমি সাধারণভাবে যখন লিটল ম্যাগাজিন কথাটি উচ্চারণ করি, তখন বাণিজ্যিক কাগজের পাল্টা ধারার কাগজগুচ্ছকেই বোঝাই, কোনো বিশেষ কাগজকে নয়।
আর লিটল ম্যাগাজিনের সংজ্ঞা? ব্যাখ্যা? আমরা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিষয়টির দিকে ধাব্মান হতে পারি মাত্র, সংজ্ঞাটা দিতে পারি না। বহুকাল আগেই আমি বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি, আপনি যখন ‘সংজ্ঞা’ কথাটি পেড়েছেন দীর্ঘ হলেও আমার প্রবন্ধের বই থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি অন্তত দিতে হচ্ছে- লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে কোনো লিটল ব্যাপার নেই, তা বাণিজ্যিক সাহিত্যের কোনো পরিপূরক নয়, প্যারালাল। লিটল ম্যাগাজিন হচ্ছে সাহিত্যের বিশিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি, বেপরোয়া, রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে যা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে, হয়ে উঠছে। এক কথায় আর্থ-সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক সমস্ত রকম স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে তার অবস্থান। তথাকথিত জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকাগুলোর প্রথম কথা হচ্ছে বাণিজ্য, দ্বিতীয় কথাও বাণিজ্য, এমনকি তৃতীয় কথাও বাণিজ্য। সৃষ্টিশীলতার প্রশ্ন সেখানে হয় অবান্তর, না হলে অত্যন্ত গৌণ। রুচিশীল পাঠক-সৃষ্টির দায়বদ্ধতা সে স্বীকার করে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচলিত স্রোতে তাকে গা ভাসাতে হয়, ভাসাতে হয় তার নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থেই। যা ছাপলে কমার্স হবে না, বিক্রি হবে না, তার পৃষ্ঠপোষকতা তারা সচরাচর করে না, করতে পারে না, কশ্চিৎ কখনো যখন করে করার ভান করে, মনে রাখতে হবে করে অবশ্যই তার শ্রেণি স্বার্থে।
অন্য ক্ষেত্রে লিটল ম্যগাজিনের মূলধন হচ্ছে সমস্ত রকম স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে তার বিপ্লবাত্মক দৃষ্টিবঙ্গি ও সাহস। বড় কাগজ, সাহিত্যের বাণিজ্য সফল কাগজ, যা যেসব ছাপতে ভয় পায় তাই ছাপবে লিটল ম্যাগাজিন, যা কখনোই এই আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বাণিজ্যিক নয়, বরং মৌলিক, একগুঁয়ে যা পরীক্ষা নির্ভর। কখনো কখনো উস্কানিমূলকও। খ্যাতিমানের অনুগ্রহের এক-আধ পৃষ্ঠার এঁটোর সে তোয়াক্কা করে না। পুরনো কালের সৃষ্টিশীল বিষয়গুলির পুনরাবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িককালে নতুন কে কি লিখছে তার একটা ধারণা তুলে ধরার দায়িত্ব লিটল ম্যাগাজিনের। প্রচলিত ধ্যান-ধারনাগুলোর ফাঁপা জায়গাটা সে দেখিয়ে দেবে, সমস্ত রকম ভাঙচুর আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করার দায়িত্ব তার, সাহিত্যের সবরকম আর সবদিকের সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখার- আর সেই সূত্রেই একধরনের বেপরোয়া আর বেহিসেবী তার ভঙ্গি। আগামী প্রজন্মের সমস্ত রকম প্রশ্ন-চিহ্নের প্রতি তার থাকবে পিতৃ-প্রতীম সহানুভূতি। লিটল ম্যাগাজিন যেহেতু মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতি নির্ভর, তাই এ বিষয়ে নানারকম মত থাকবে, থাকতে পারে, সে-সবকেই তুলে ধরবে লিটল ম্যাগাজিন- কেননা তাই প্রবাহিত মনুষ্যত্ব, তাই জীবনের লক্ষণ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে লিটল ম্যাগাজিন থেকে আরো বেশি চাই- এ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট মানসিকতা। প্রচন্ড রাগী চেহারা হবে তার, কোনোরকম কম্প্রোমাইজের মধ্যে নেই সে। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে তার বিতৃষ্ণা হবে আন্তরিক, ব্যবসায়িক স্বার্থে যে সব আধমরা লেখককে প্রতিষ্ঠান তুলে ধরতে চায়, দেখাতে চায় এরাই লেখক, এদের লেখাই ১নং, আগ-মার্কা এবং বাজারের সেরা মাল-তাদের, সেইসব যশ-কাঙালদের মুখোশ খুলে দেওয়ার দায়িত্বও লিটল ম্যাগাজিনের। প্রচলিত দৈনিক সাপ্তাহিকগুলোতে সাহিত্যের নামে কুচো চিংড়ির যে রগরগে ঝালচচ্চরি চালাবার চেষ্টা হয়, তা সুস্বাদু হতে পারে কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে তা মারাত্মক, সেখান থেকে কলেরা ছড়াবার সম্ভাবনা প্রবল। এ সম্পর্কে পাঠককে সতর্ক করে দেবার দায়িত্বও লিটল ম্যাগাজিনের। মোদ্দা কথা, অন্যভাবে বললে, আমাদের সমাজের কাঠামোগত দিক, উৎপাদন ব্যবস্থা, সেখানে যেমন ধনী-দরিদ্রের লড়াই আছে, সংস্কৃতির জগতেও চারিয়ে আছে সেই একই লড়াই। যে কাগজের পুঁজি তিনশ টাকা আর যে কাগজের তিরিশ লক্ষ তাদের উদ্দেশ্য কখনো এক হতে পারে না। সাহিত্য-সংস্কৃতির ব্যবসায়িক কাগজের সঙ্গে নিজের নাম জড়ানোকে আমি এক ধরনের বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া অন্য কিছু মনে করি না।
পথিক : যেহেতু আপনি একসময় কবিতীর্থ, কোরক, অনুষ্টুপ, বিজ্ঞাপন পর্ব প্রভৃতি কাগজে লিখেছেন তাহলে তো অবশ্যই ধরে নিচ্ছি সেগুলো একসময় অবশ্যই লিটল ম্যাগাজিন ছিল। আপনি অনেক জায়গায়ই লিখেছেন প্রাতিষ্ঠানিক কাগজে একটি শব্দও না লিখে আপনি সম্পূর্ণ লিটল ম্যাগাজিনের লোক এবং অন্যত্র এক জায়গায় লিখেছেন- আমাকে তো কোথাও না কোথাও লিখতে হবে। তাহলে এখানে কি কন্ট্রাডিকশন তৈরি হচ্ছে না? অর্থাৎ পুরো লিটল ম্যাগাজিন না হয়ে প্রায় লিটল ম্যাগাজিন হলেই (আমরা যেগুলোকে এলিম্যান্ট না মনে করলে তো আপনি সেসব কাগজ থেকে সরে আসতেন না। তাহলে ইদানিং যে আপনি বোবাযুদ্ধ, সমবেত আর্তনাদ, গ্রাফিত্তির কাগজে লিখেছেন সেগুলোও কি একসময় সেমত গড় কাগজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে না?
সুবিমল মিশ্র : এসব কাগজে কখনও আমি লিখেছি, লিখেছি এগুলো প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন বলে নয়, লেখার কোনো জায়গা ছিল না বলে। তখনও ছিল না, এখনও নেই। যাকে ১০০ ভাগ প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটল ম্যাগাজিন বলব, এমন একখানা কাগজ তৈরি হয়নি, তৈরি হতে হতেও হয়নি। তখন মন্দের ভাল কাউকে না কাউকে বেছে নিতে হয়, আর ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে বলে আগে চায় চোখ বুঁজে তাকেই দিয়ে দিই। যখন লিখি ‘আমাকে কোথাও না কোথাও লিখতে হবে’ তখন কত দুঃখে, কত অসহায়তায় একথা বলতে হচ্ছে বুঝতে পারেন কি? বাণিজ্যিক কাগজ বিষের মতো পরিত্যাগ করলাম ঠিকই, কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন যাকে বলছি, তার মধ্যেও যে ভেজাল। কোথাও একটি বেশি কোথাও একটু কম এই যা। এইরকম যেখানে সাহিত্যের বাজার তখন সুবিমল মিশ্র কি করবে? যতদিন না পণ্যসর্বস্বতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মত একটি লিটল ম্যাগাজিন তৈরি হয় ততদিন লেখা বন্ধ রাখবে? অবস্থাটাতো বছর তিরিশেরও বেশি দেখে আসছি। এই তিরিশ বছর বোধ হয় আমার একটাও লেখা না-ছাপা উচিত ছিল, লিখে পা-ুলিপি ফেলে রাখা উটিত ছিল।
[আর কন্ট্রাডিকশন যাকে বলছেন তা আমার মধ্যে আছে, না থাকলে আমি মনুষ্যপদবাচ্য হতাম ‘Thinking Read’ হতাম না, তবে আপনি যেটা বলছেন তা কিন্তু কন্ট্রাডিকশন নয়।]
আমি জ্যোতিষি নই। ভবিষ্যতে কোন্ জাতীয় কাগজ কি রূপ নেবে, আদৌ থাকবে কিনা এসব আগের থেকে বলা সম্ভব নয়। এদেশে ‘গড়’ জিনিষ সবসময়েই বাজার পায়, আর বাজার পেতে গেলে তাকে গড় মাল হয়ে যেতেই হয়।
বেশ কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন জাতীয় কাগজ তা হয়েছে, আরও বেশ কয়েকটির তা হবার সম্ভাবনা আছে। এক জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল, এখন গিয়ে ঠেকেছে তা অন্য জায়গায়, শুধু ওপর ওপর আছে। এক জায়গা থেকে শুরু হয়েছিল, এখন গিয়ে ঠেকেছে তা অন্য জায়গায়, শুধু ওপর ওপর লিটল ম্যাগাজিন এই ভনিতাটুকু আছে। আর এদের, এইসব ‘টান’-এর সম্ভাবনা রাখবার সাধ্য আমার নেই...
পথিক : বুঝতে পারলাম আপনার প্রতিষ্ঠানবিরোধি চরিত্রের সততাকে শুদ্ধ রাখার জন্য আপনি যে কোনো সময়েই সব বাতিল করে দিতে পারেন। যেমন আজ যে দ্রষ্টব্য বা বোবাযুদ্ধে আপনি লিখছেন ওরা যদি প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রের কাছে কখনও আপোষ করে তাহলে তা অবলীলায় ছেড়ে/বাতিল করে আপনার শুদ্ধতাকে সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু কখনও কি ভেবেছেন একটি লিটল ম্যাগাজিন তার শুদ্ধতাকে সংরক্ষণ করতে কিভাবে বাতিল প্রক্রিয়াটি কার্যকর করবে?
সুবিমল মিশ্র : ‘শুদ্ধতা’ কথাটা বড্ড কানে বাজছে। আর প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন করতে চাওয়াতো একটা যুদ্ধ। ছোটোখাটো নয় বেশ বড়সড় যুদ্ধই, অন্তত এই ব্যবস্থায় যেখানে দু-একটি সংবাদপত্র গোষ্ঠি পুরো সংস্কৃতি-জগতটাকে কব্জা করে রেখেছে। প্রতিষ্ঠানের বহুরুপিত্ব-র কথাতো অনেকবার বলেছি, অসংখ্য জায়গায়। অসংখ্য তার ছদ্মবেশ, ডালপালা ছড়ানো। সেখানে যুদ্ধ করতে হবে, অভিজ্ঞতা আসবে কাজের ভেতর দিয়ে, যুদ্ধ করতে করতে কখন দু-এক পায়ে হেঁটে যাবার অবস্থা আসতে পারে, সাময়িক দ্বিধা দ্বন্দ্ব লড়াই এর মানসিকতা গ্রাস করে নিতে পারে, তবে আলটিমেট টার্গেটটা তার থাকবেই, সেটা না থাকলে কিছুইতো তার থাকল না।
পথিক : আপনি একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এবং মানুষ। শুধু তাই নয় প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা বলতে পারি। এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকদের জন্য অনিবার্য হল লিটল ম্যাগাজিন। আমি মনে করি লিটল ম্যাগাজিন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ১০০ ভাগ পরিপূরক। যেভাবে লিটল ম্যাগাজিনের অস্তিত্বের জন্য অনিবার্যভাবে প্রয়োজন হচ্ছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক, তেমনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকদের/আন্দোলনের ধারণ এবং বাহনে অনিবার্যভাবে প্রয়োজন হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিন। তাহলে আপনি অনেক কষ্টে-সিষ্টে আপনার বেশ কটি গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারলেন। কিন্তু আপনি কি মনে করেন প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটি লিটল ম্যাগাজিন (যা একটি স্থায়ী উদাহরণ হতে পারতো) আপনার তৈরি করা প্রয়োজন ছিল? করেননি কেন? এটাকে কি আপনি দায়িত্ব এড়ানোর মধ্যে ফেলবেন? আপনার মত প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকের লেখা যখন বাংলাদেশে ড্যাফোডিল আর নিসর্গের মত কোনো মিডি ম্যাগাজিনে ছেপে বেরোয় তখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের অভিযোগ আপনি কিভাবে খন্ডাবেন?
সুবিমল মিশ্র : আগেই বলেছি আমার কাছে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কোনো আন্দোলন নয়, একটি জীবনপদ্ধতি, একটি জীবনদর্শন। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে আন্দোলন করে দাঁড় করাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমি জোটবদ্ধতায় আস্থা রাখি না, আন্দোলনের নামে দল তৈরি করে চিৎকার চেঁচামেচি করা যায়, পার্টি গড়া যায় কিন্তু কোনো সৃষ্টি সম্ভব নয়। চিৎকার চেঁচামেচির ফলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় কিন্তু সৃষ্টিতে গভীরতা আনা শক্ত। স্রষ্টাকে সব সময়ই একক পথ চলতে হয়,- একা, নিঃসঙ্গ, নিঃস্তরঙ্গ। জোট সবসময় Surface-এ বিস্তারী, গভীরতায় নয়।
তবু পত্রিকা যে আদৌ করিনি তা নয়। ‘অন্যরূপ রূপান্তর’ (শুধুমাত্র অনুবাদ কবিতার অন্যতর কাগজ), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ (অন্যতর গদ্যভিত্তিক), ‘অ্যায়কিলোসার’ (প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সূচনা কিন্তু এই কাগজ থেকেই), পরে ‘বিজ্ঞাপন’ আরও পরে ‘বিজ্ঞাপন পর্ব’, ‘কবিতীর্থ’। ‘বিজ্ঞাপন’ বলে যে কাগজটি করেছি (পরবর্তীকালে তা বিজ্ঞাপন পর্ব) প্রথম দিকের সংখ্যাগুলো খুঁজে দেখলে বুঝবেন তা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাগজ হিসেবেই বিবেচিত হত (যদিও সম্পাদক হিসেবে নিজের নাম কখনও ব্যবহার করিনি, করেছি এক বিশ্বস্ত বন্ধুর নাম)। ‘বিজ্ঞাপন’ ১৯৭৬ এর নভেম্বর সংখ্যায় (চতুর্থ সংকলন) সারা কাভার জুড়ে অক্ষর সাজিয়ে ব্যানারটি করেছিলুম এই রকম-
‘ব্যবসায়ী কাগজগুলি যখন ক্রমশ সাহিত্যিক আলুপটলের মত বেচতে শুরু করেছে, যখন আমাদের চোখের সামনে টন টন কাগজে সাহিত্যের নামে ভূষিমাল ছেপে বের হচ্ছে প্রতিনিয়ত তখন এই সংখ্যার বিজ্ঞাপনে প্রতিটি ইঞ্চি ঋত্বিক কুমার ঘটক, জাঁ পল সার্ত্র, জাঁ লুক গদার, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাসগুপ্ত, সুবিমল মিশ্র, শংকর বসু, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, অরূপরতন বসু, দেবজ্যোতি চক্রবর্তী, রবীন ঘোষ, অজয় গুপ্ত এবং মানিক বন্দোপাধ্যায়দের সৃষ্টিশীলতার সম্মানে ব্যবহার করা হল।’
এইসব লেখকের লেখাই ছিল এই সংকলনে। এই সংখ্যাতেই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ম্যানিফেস্টো প্রথম ছাপা হয়। সংখ্যাটি বেরুলে তথাকথিত সাহিত্যবাজারে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। (এখানে এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ‘পাঠক সমাবেশ’ নাম দিয়ে সমবায় ভিত্তিতে বই প্রকাশের প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম কয়েক বছর আগে। সিরিয়াস পাঠকের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে অন্য ধরণের বই প্রকাশের চেষ্টা। [আপনাদের বিজু (পাঠক সমাবেশ) আমার কাছে স্বীকার করেছে তার পাঠক সমবায় গঠনের প্রেরণা সে এখান থেকেই পেয়েছে। বিজু শুধু একটা নাম নয় আমার কাছে, সে আমার বড় বন্ধুও, বিশেষ শুভার্থী।] এই পদ্ধতিতে আামর ‘নাঙা হাড় জেগে উঠছে’ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়, সম্ভবত সত্তর-আশি জন বইটি প্রকাশের জন্যে টাকা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ছিলেন, তাঁর কথা মনে আছে। এই পাঠক সমবায় সম্পর্কে আমার লেখা ব্যানারটি ছিল এই রকম-
‘পাঠক সমবায় সম্পর্কে কি আপনি অবহিত?
পাঠক সমবায় রুচিবান পাঠক তৈরি করতে চায়। আমরা বাজার-চলতি লেখালেখিতে বিশ্বাস করি না। সাহিত্য যেখানে পণ্য আমাদের মুখ তার উল্টো দিকে ফেরানো। আমার কাজকর্ম শুধুমাত্র সিরিয়াস সাহিত্যের জন্য- যেখানে পাঠক সীমিত এবং সর্বতোভাবে রুচিবান। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা শ্রদ্ধা জানাই তরুণ অথচ সৎ প্রতিশ্রুতিকে, বৃহত্তর পাঠক সমাজে পরিচিত করবার চেষ্টা করি। ভাষাকে, সাহিত্যকে সৎ রাখতে পাঠক বাড়াতেই হবে। আপনি যদি সৎ পাঠক হন, তা হলে সঙ্গে আসুন, আমরা ভবিষ্যৎ কালের সাহিত্যের জন্যে অন্তত কিছু করার দায়িত্ব নিই।
তা যা বলছিলাম যে ব্যক্তি যত বেশি করে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করতে পারে পত্রিকার কন্ট্রোলও সে ততো বেশি করে পায়। শেষে এমন হল কলকাতা পুস্তক মেলায় আমার স্বনামে সম্পাদিত কোনো কাগজ ছিল না বলে আমি কোনো টেবিল অ্যালটমেন্ট পেতাম না। একসময় আমার বইপত্র রাখার কোনো জায়গা ছিল না। এসব ঘটনাকে এখন আমি প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেই দেখি। পরে ‘কবিতীর্থ’-ও এই একই ব্যাপার করল, যদিও এই পত্রিকার কোনো প্রতিষ্ঠানবিরোধী অ্যাপ্রোচ ছিল না। আসলে আর্থিক কনট্রোল হাতে না থাকলে কোনো কনট্রোল টেকে না।
কথায় কথায় কথা বলে ফেললাম। আসলে এগুলি তথ্যমাত্র। কাউকে আঘাত দেওয়ার জন্য বা কারোর কুৎসা করার জন্য আমি এসব বলছি না। ব্যক্তিগতভাবে রবিন ঘোষকে আমি আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু মনে করি, আমার বিরুদ্ধতা ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, সম্পূর্ণত আদর্শের পর্যায়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি যেহেতু পত্রিকাগুলির আর্থিক রাশ আমার হাতে ছিল না, তাই ক্রমে ক্রমে তা হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। যে বিজ্ঞাপন আনতে পারে তার নাম স্বভাবতই সম্পাদক হিসেবে ছাপা হয়, ক্রমশ তার নিজস্ব ইচ্ছা অনিচ্ছাই কাগজটির চরিত্রের নিয়ামক হয়ে ওঠে, একসময় ঘাড় ধাক্কা খেয়ে মানে মানে সরে পড়তে হয়। এটা বাস্তব ঘটনা। কোনো আদর্শ টাদর্শ বালাই থাকে না তখন, যদিও একটা বিরাট আদর্শ সামনে রেখে কাগজ তৈরি হয়।
হ্যাঁ, ড্যাফোডিল, নিসর্গ ওরা তো বেশ বিরোধী ধরনের কথা বলে চিঠি দিত, কয়েকখানা চিঠি দিয়েছিল। আমি ব্যাসিক্যালি মানুষকে অবিশ্বাস করতে পারি না, লেখা দিয়েছিলাম কিন্তু কোনো নতুন লেখা নয়, ছাপা লেখা, আর প্রশ্ন পাঠিয়েছিল, আমার সাধ্যমত উত্তর দিয়েছি। আমাকে তো কেউ বলেনি, জানিও না, পরে আপনাদের কথায় ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। এই তো হল ঘটনা, তা এখানে আপনি আমাকে কি করতে বলেন? কাকে বিশ্বাস করব, পরে লোকটি যে এরকম করবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? তবু আমি ব্যাসিক্যালি মানুষকে বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করেই ঠকি, বারবার ঠকি, এছাড়া আমার কাছে আর অন্য পথ নেই।
পথিক : আপনার গ্রন্থ আপনি নিজেই ছাপেন এবং এতে লাভ হচ্ছে নিজের মত করে বলতে পারছেন। এতে আপনার প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্রের এতটুকু ক্ষুণ্ণ হতে পারছে না। কিন্তু বর্তমানে আপনার বই প্রকাশক ছাপছে। ছাপতে দিচ্ছেন। আপনি কি মনে করেন এ প্রকাশক প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রকাশক? অথবা আপনি কি প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনে প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রকাশক প্রত্যাশা করেন? এ প্রেক্ষিতে লিটল ম্যাগাজিনগুলো প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রকাশনা সংস্থায় পরিণত হোক তা কি আপনি কল্পনা করেন? যদি তা না ভাবেন তাহলে আনন্দ আপনার গ্রন্থ ছাপলে ক্ষতিটা কোথায়?
সুবিমল মিশ্র : এ সম্বন্ধে খুব বিস্তারিতভাবে আমি অন্য সাক্ষাৎকারে বলেছি। অ-য়ে অজগর সুবিমল মিশ্র সংখ্যায়, ‘সুবিমল মিশ্র-র সঙ্গে কথাবার্তা’ (‘সমবেত আর্তনাদ’ পত্রিকায় দেওয়া) দেখে নিলে ভালো হয়।
খুব সংক্ষেপে বললে এতদিনে আমার নিজের বই নিজে ছেপেছি, ছেপে এসেছি। এক শ্রেষ্ঠগল্প বাদে আমার প্রতিটি বই-ই আমার নিজের পয়সা ও উদ্যোগে ছাপা। এখন আর্থিকভাবে আমি খুবই পর্যুদস্ত, আর সম্ভব হচ্ছে না, শরীরেও কুলোচ্ছে না। অনেক বই এখন আর ছাপা নেই, কোনো কোনোটার অল্প কিছু কপি অবশিষ্ট আছে মাত্র। এ অবস্থায় ছোট প্রকাশক বা লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশকের কাছে, তাদের প্রার্থনা বা অনুরোধেই ছাপতে দিয়েছি বা দিচ্ছি। না, কোনো কারণে নিজে যেচে আমি বড় প্রকাশকের কাছে যাইনি, তাদের আমন্ত্রণ সত্ত্বেও নয়। আর একটা কথা, যে বই আমি প্রকাশককে দিচ্ছি তা সবসময়ই দ্বিতীয় সংস্করণে, প্রথম সংস্করণ আমি নিজেই ছাপি, শেষ বই ‘সত্য উৎপাদিত হয়’ পর্যন্ত আমার নিজের ছাপা। হ্যাঁ, অবশ্যই সুদে টাকা ধার করে।
আমার কোনো বই যদি ছাপা না হয়, আদৌ, কোনো কিছুই না থাকে, তবু কোনো বই আমি আনন্দ পা’ব-কে ছাপতে দেবো না।
বইকে যে আমি কমোডিটি হিসেবে দেখি না, বই বিক্রি করে পয়সা করা যে আমার উদ্দেশ্য নয়, তা আমার বই-সংক্রান্ত বুকলেটের অংশ থেকেই বোঝা যাবে। [যারা অন্যধারার প্রকাশক হিসেবে নিজেদের জাহির করে বেড়াচ্ছে, এত এত বই ছাপছে-তারা আমার একটা বই করতে চাইছে না কেন জিজ্ঞেস করুন।
...................................................................................................................................................................
না, সুবিমল-এর বই কোনো কমোডিটি নয়, [রোলা বার্ত-কে মনে রেখো]
লেখালেখির ৩০ বছর পর, ৯৭-তে এসে, সুবিমল মিশ্র বইপত্র’র আর কোনো নির্দিষ্ট বিনিময় মূল্য নেই। তাঁর যে কোনো বই, পাঠকের নিজের সাধ্য অনুযায়ী, যে কোনো দামে সংগ্রহ করা যেতে পারে। ন্যূনতম এক টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ দশ কুড়ি পঞ্চাশ একশ- একটা ‘টোকেন মানি’ আপনাকে দিতে হবে, বই ‘কিনতে’ হবে। অবশ্যই আপনার সাধ্য অনুযায়ী- কেননা তা কোনো কারণেই বিনে পয়সায় বিলোনো হচ্ছে না। এই বিনিময় ব্যবস্থা কেবলমাত্র লেখকের নিজের প্রকাশ করা বইয়ের ক্ষেত্রে (৯৫% বই-ই এর আওতায় আসে) প্রযোজ্য এবং সরাসরি তা লেখকের কাছ থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। আবার মজাও আছে, একই বইয়ের বিভিন্ন বিনমিয় মূল্যও থাকতে পারে, অনেকটা লটারির মতো, যে যেটা তুলবেন সেই দাম তাঁকে দিতে হবে, মোটকথা ‘দাম’-এর কবল থেকে ‘বই’-কে যথাসাধ্য মুক্ত করে আনার চেষ্টা, বাণিজ্যিক হতে না চাওয়া, সাধ্যমত। একটি সবিনয় নিবেদন, আমরা সবাইকে বই বেচিনা, আগ্রহ না থাকলে, পাঠক না হলে অনুগ্রহ করে আমাদের বই কিনবেন না।
স্পষ্ট করে উল্লেখ করে রাখা প্রয়োজন যে বইগুলোতে একটা ‘বিনিময় মূল্য’ রাখতে হয়েছে, নির্দিষ্ট করে রাখতে হয়েছে, কখনো কখনো তা স্টিকার মেরে, দাম বাড়িয়ে, সেটা যাঁরা দোকান থেকে বই কিনবেন তাঁদের জন্য প্রযোজ্য। সেখানে একটা নির্দিষ্ট দাম না রাখলে লেনদেন এর সার্বিক অসুবিধে হয়। সে ক্ষেত্রেও দোকান থেকে না কিনে লেখকের ঠিকানায় চিঠি লিখে বাই-পোস্টে যোগাযোগ করে নিতে পারলে আর্থিক সুবিধা হবে।
সুবিমলের বই শুধুমাত্রা পয়সা কামানোর সোর্স নয়। (যদিও প্রোডাকশনের কষ্ট হিসেবে বিনিময়ের কিছু টাকা নিতে হয়), অধিকাংশ বইতে কোনো-না ভাবে লেখকের একটা পারসোনাল টাচ্ থাকেই। কোনো বই কেনার পর যদি মনে হয় সেটি কেনার যোগ্য নয়- তবে এক সপ্তাহের মধ্যে লেখককে সরাসরি বইটি ফিরিয়ে দিয়ে পয়সা ফেরৎ নিতে পারেন। হ্যাঁ, যা ভাবছেন ঠিক তাই, সুবিমল মিশ্র কোনো কারণেই অর্ধমনস্ক-মানসিকতা প্রার্থী নয়।
কিছু কথা,
সুবিমল মিশ্র’র পাঠকদের কাছে
এটা খুবই লজ্জার ও দুঃখের যে, কোনো কোনো বইয়ে স্টিকার মেরে দাম বাড়িয়ে আমাকে বিক্রি করতে হচ্ছে। আমার সব বই-ই প্রথম সংস্করণ আমি নিজে ছাপি, নিজে বিক্রি করি- করে আসছি আজ পর্যন্ত। কলেজ স্ট্রিটের দোকানগুলোতে আমার বই পাওয়া যায় না, ওদের সাহায্য না নিয়ে অন্যধরনের বইয়ের, অ-বাণিজ্যিক বইয়ের একটা সমান্তরাল পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করা যায় কিনা, সারাজীবন ধরে পরীক্ষা করে দেখছি, দেখতে চেয়েছি। এমন বইও আছে যা ২৫ বছর আগে ছাপা। একটা অন্তত বাস্তব সত্য এই যে, আমার প্রায় ১৮-২০ খানা বই রাখার জন্য আমাকে বছরে একটা বিরাট অংকের গোডাউন ভাড়া দিতে হয়। বিগত ২৫ বছরে বই বাঁধাই-এর দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে। বন্যা তো বইপাড়ার ফি-বছরের ব্যাপার, তাতওে প্রচুর নষ্ট হয়, বেশ কিছু ফর্মা জলে ডুবে শেষ হয়ে গ্যাছে, কিছুতে পাকায় কেটেছে, দুটো বইয়ের ফর্মা গোডাউন থেকে হারিয়ে গেছে, খান-তিনেক বইয়ের কভার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এইসব এতসব করেও কোনো বইয়ের অর্ধেক দামও আমি রিটার্ন পাইনি, এক বইমেলা ছাড়া সরাসরি পাঠকদের কাছে পৌঁছানোর কোনো জায়গাও নাই। কলেজস্ট্রিটের পাতিরাম-এ কখনো কখনো কিছু বই পাওয়া যায়, কিন্তু সেখানে বিরাট একটা কমিশন দিতে হয়, অথচ আমার ক্রেতাদের তাতে কোনো সুবিধে হয় না। বাণিজ্যিক বইয়ের সমান্তরালে এই অবাণিজ্যি বইগুলিকে বুকের রক্ত দিয়ে আগলে রাখি, আমার সত্যিকারের পাঠক না হলে দিতে চাইলেও বিক্রি করি না। কেননা একটা সংস্করণ শেষ হয়ে গেলে এই বয়সে এই শরীর নিয়ে দ্বিতীয়বার বই ছাপা আমার পক্ষে আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই খুবই অশোভনভাবে হলেও স্টিকার মেরে বইয়ের দাম বাড়াতে হয়, যদিও ‘বিনিময় : সুবিমল মিশ্রর পাঠক হলে যা হওয়া উচিত মনে করেন’- সব সময়ই বজায় থাকে। সত্যিকারের পাঠক হলে একটাকা দিয়েও সুবিমলের বই কেনা যায়- এক টাকা মানে একটা টোকেন মানি। হ্যাঁ এইভাবে, প্রায় এককভাবে ৩০ বছর ধরে সমস্ত রকম বাণিজ্যসর্বস্ব প্রকাশনার সমান্তরালে লড়ে যাওয়া তো আমার একশ্রেণির পাঠকের সহমর্মিতার জোরেই- যে পাঠক আমার কাছে নমস্য, কমলকুমার যে পাঠকের জন্য প্রণাম জানিয়ে গেছেন।
পথিক : এক্ষণ, বিভাব, প্রমা, অনুষ্টুপ, কৌরব, জিজ্ঞাসা, বিজ্ঞাপন, পর্ব ইত্যাদি কাগজ থেকে আপনি সরে এসেছেন। এ সরে আসার পেছনে কি ব্যক্তিগত বিরোধ কাজ করেছে? না প্রতিষ্ঠান বিরোধের প্রশ্ন জড়িয়েছিল? আপনি বর্তমানে প্রতিষ্ঠান বিরোধী কাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন বলতে কোন কোন পত্রিকাগুলোকে বলবেন?
সুবিমল মিশ্র : পূর্বোক্ত প্রশ্নের উত্তরে আমি এই সব অনেক কথাই বলেছি। ব্যক্তিগত বিরোধকে আদর্শগত বিরোধ হিসেবে দেখানোর মধ্যবিত্তীয় প্রবণতার প্রতি আমার একটা জাত ঘৃণা আছে (দৃষ্টান্ত হিসেবে বিজ্ঞাপন পর্বের রবিন ঘোষকে আমার বড় বন্ধু হিসেবে মনে করি কিন্তু আদর্শগতভাবে তার সঙ্গে অনেক জায়গায় মেলে না), যেটার আবার আজকে খুব চল। আজকে যে বন্ধু, আদর্শ লেখক, স্বার্থে ঘা লেগে বিরোধ বাধার পর সেই চরম শত্রু হয়ে যায়, অ-লেখক। এর ভেতরে এক প্রবল হীনমন্যতা কাজ করে। তবে আমি মনে করি কোনো জিনিসই স্থির নেুই, থাকে না, এই সব কাগজের দৃষ্টিভঙ্গিও নয়। প্রশ্ন, এরা কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকে ঝুঁকে পড়ার ঝোঁক। এদের কারো কারোর মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন হয়ে ওঠার প্রবণতা ছিল, আমি লিখেছিও কোনো কোনো কাগজে, যেমন অনুষ্টুপ-এ, সত্তরের গোড়ায়, শীর্ণকায়, ক্রিয়েটিভ লেখা যখন সম্মানমূল্য পেত সেখানে।
আজকের অনুষ্টুপ দেখলে হাসি পায়। গল্পে-টল্পে তো দুনিয়ায় যত অ-লেখকের ভিড়, বস্তাপচা সেই সমাজ বাস্তবতার গল্প, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা ‘ভোরে সূর্য ওঠার’ গল্পের রকমফের মাত্র। এঁরা এসব ছেপে যাচ্ছেন, এখন এই দু’হাজার সালের প্রবেশের মুখেও। মূর্খতা যে কত সর্বব্যাপী হয় তা এদের গা-জোয়ারী সাহিত্য-ধান্দা দেখলে মালুম হয়। এক্ষণ একদা কমলকুমার, অমিয়ভূষণ ছেপেছিল, এর প্রতি একটা দুর্বলতা ছিল আমার, কিন্তু সুনীল গাঙ্গুলী, প্রফুল্ল রায় ছাপতে শুরু করায় এদের সাহিত্য ভাবনার (বিশেষভাবে কথা সাহিত্য) ফাঁকিটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমি তো, একটু ঘুরিয়ে হলেও এক্ষণে লেখা দিতে অস্বীকার করেছি। কমলবাবুর সময়কার এক্ষণ আর শেষের দিকে এক্ষণের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ ঘটে গিয়েছিল, বিশেষভাবে কথা সাহিত্যের দিক দিয়ে। আমার রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন-তে এর ইঙ্গিত আছে। এগুলির কোনোটিই আর লিটল ম্যাগাজিন নেই, আগে হয়তো কোনো-কোনোটা কিছু কিছু ছিল। আর এগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা খোঁজাটা বৃথা চেষ্টা, একমাত্র বিজ্ঞাপন পর্ব (যখন শুধু বিজ্ঞাপন ছিল) ছাড়া।
পথিক : একবার আপনি বলেছিলেন- “বেসিক্যালি আমি ভদ্রলোক নই, ভদ্দরলোক সেজে থাকতে হয়”। আপনাকে পাঠকও উগ্রই ধরে নেন। এখানে আমরা পাঠক এবং লেখকের একটা ঐক্যই টের পাই। কখনও আপনার মনে হয়েছে এই ছদ্মবেশ ক্ষতিকর।
সুবিমল মিশ্র : ভদ্রলোক বলতে আমি ‘মধ্যবস্তু-মূল্যবোধ’ বোঝাতে চেয়েছি। এই ফাঁপা মূল্যবোধে আমার বিশ্বাস ছিল না, আজও নেই। সাধারণভাবে লোকের সঙ্গে ইচ্ছে করেই অভদ্র ব্যবহার করি, ছোট লোকমি করি, আঘাত দিয়ে কথা বলি। আমার ঘরখানা তো এইসব মূল্যবোধের প্রতিবাদের প্রতিমূর্তি-আপনার কি দেখে মনে হয়নি? কিন্তু আবার আমার এসব ব্যবহার কারো ক্ষতি করবে মনে হলে আমি নিপাট ভদ্রলোক সেজে যাই। যখন মাস্টারি করি তখন তো ভদ্রলোক সেজে থাকতেই হয়। যদিও ছাত্রদের কাছে সবসময় সবরকম মূল্যবোধ যাচাই করে দেখে নেওয়ার কথা বলি, সর্বদা ধরে নেয়া সত্যকে আক্রমণ করতে শেখাই। তবে এসবকে আপনি যদি ছদ্মবেশ বলতে চান আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করব না। ...আর ‘ভদ্রলোক’ শব্দটির বিপরীত মেরুতে ‘উগ্র’ শব্দটি বসানো যায় না বোধ হয়।
আর পেশা?...যে দেশে চাকরি মেলে না সে দেশে পেশা বাছাবাছির কথা হাস্যকর। মোদ্দা কথা কতটা নিজেকে এই ‘ব্যবস্থার’ বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারছি সেটাই বড় কথা। সুযোগ পেলে তা করে নিতে হবে। আমি মাস্টারি করি অবশ্যই, তবু, তার মধ্যে ‘সোনাগাছি’ অঞ্চলটা বেছে নিয়েছি, -সমাজের একটা দিক, শতকরা ১০০ ভাগের ১০০ ভাগই এখানে প্রত্যক্ষ করা যায়, যাকে বলে ‘চাক্ষুষ’ করা। বড় মাস্টার হতে চাইনি (কলেজ), সংবাদ পত্রেও যাইনি, হেডমাস্টার হতেও রিফিউজ করেছি- এসব যদিও ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনার ভাষায় এগুলো কি ‘ছদ্মবেশ’?
পথিক : মাঝেমধ্যে কোলকাতার বোদ্দা লেখকদের বাংলাদেশের লেখালেখি সম্পর্কে ভালো করে জ্ঞাত নন দেখে অবাক হই। তাই শুধুমাত্র লেখা ছাপার জন্য যেখানে সেখানে লিখতে কুণ্ঠিত হন না এবং লিটল ম্যাগাজিনের লেখক বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখকের অদ্ভুত লিস্ট সাজিয়ে ফেলেন। আপনি কি এ ব্যাপারে জ্ঞাত? আপনার সাম্প্রতিক হাড়মড়মড়িতে বাংলাদেশের কিছু প্রাতিষ্ঠানিক লেখকের পজিটিভ অবস্থান দেখতে পাই। আপনার গল্পের একটি পজিটিভ ক্যারেক্টার কি প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া উচিত নয়?
সুবিমল মিশ্র : কলকাতার এই সব ‘বোদ্ধা লেখকদের’ দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমিও বাংলাদেশের লেখালেখি সম্পর্কে জ্ঞাত নই, প্রায়ই এমন সব পরস্পরবিরোধী খবর আসে যে মাঝে মাঝে ভড়কে যেতে হয়। উপর উপর ভান করে কোনো লাভ নেই। আমার লেখা ছাপতে হলে মাসের পর মাস ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকতে হয়। আমিও বাজিয়ে দেখি সে কতটা আগ্রহী। বহুবার বহু অনুরোধ এসেছে অথচ আমি বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কোনো লেখা প্রথমে এখানে না ছাপিয়ে পাঠাইনি। যে কটি লেখা ছাপা হয়েছে- কটি তা হাতে গুনে বলা যায়- সবই কিন্তু রিপ্রিন্ট এবং অনেকবার অনুরোধের পর পাঠানো। কিন্তু লেখাটা ছাপা হওয়ার পর একটা কপি পাঠানোর সাধারণ সৌজন্যটুকুও অনেকে দেখায় না। আপনাদের ওখানকার একটি পত্রিকা নিসর্গ এখন পর্যন্ত কোনো সৌজন্য সংখ্যা পাঠাল না, অন্তত আমার হাতে এসে পৌঁছায়নি (রেজিস্ট্রি ডাক তো সচরাচর মারা যায় না দেখেছি)।
লেখা ছাপা সম্পর্কে কয়েকটা কথা এখানে বলে নিই। আমার লেখা রিপ্রিন্ট করতে কাউকে বাধা দিই না। দিই না এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক মনোভাব বলে। নতুন লেখা দিই না, চিঠি দিই-কিন্তু রিপ্রিন্ট কেউ করতে চাইলে সাধারণত আমি পারমিশান দিয়ে থাকি। অনেকবার লেখা চাইবার পর আমি যখন রিপ্রিন্ট করার কথা বলি, পরিষ্কারভাবেই বলে রাখি ‘দি পত্রিকার পলিসিতে না বাধে’ এবং ‘সুবিমল মিশ্রের লেখা ছাপতে আগ্রহী হন’ তবেই রিপ্রিন্ট করতে পারেন। এ কথাগুলি দিয়ে কি কাউকে আমার লেখা ছাপাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি? ‘আগ্রহ’ দেখাচ্ছি? (শুনেছি নিসর্গ পত্রিকায় এইরকম একটি বাক্য নাকি আমার নামে ছাপা হয়েছে।) জানি না, আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না। তবে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহৃত হবে এমন কোনো কাগজকে কোনো দিন আমার লেখা রিপ্রিন্ট করার লিখিত অনুমোদন দিইনি।
এখন মজাটা হচ্ছে কে কাকে ব্যবহার করতে চাইছে সেটা বোঝা। যাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর কথা বলি, তারা যখন কোনো লেখা রিপ্রিন্ট করার জন্য আগ্রহ দেখায় (দুই বাংলারই) তখন মজাটা টের পাই আমি। পরিষ্কার বুঝতে পারি তারা আমার কথাগুলো ছাপিয়ে নাম কিনতে চাইছে। একটা সময় থেকে আমাকে অনেকেই ব্যবহার করতে চেয়েছে, করেছেও, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যেও আমি তাদের লোক হয়ে যাইনি। আমি আমার স্ট্যান্ড পয়েন্টে ঠিক আছি প্রতিষ্ঠানবিরোধিতায়। কে কোথায় কিভাবে আমার লেখা রিপ্রিন্ট করছে, করে নিজেদের দলে টানছে, টানতে চাইছে তা আমার পক্ষে খোঁজ রাখা সম্ভব নয় এবং তাদের বাঁধা দেওয়াও সম্ভব নয়। কিন্তু যেটা সম্ভব তা আমি করি, করে যাই। নিজের লক্ষ্য স্থির রেখে শুধু আপন কাজটুকু করে যাওয়া, স্থির লক্ষ্যে করে যাওয়া। আর এটুকুই আমি পারি। আপনারা শুনে অবাক যাবেন যে, এখানে একটা আস্ত ইন্টারভিউ আমার নামে ছাপা হয়ে গেছে। ‘তথ্য কেন্দ্র’ নামে একটি বাণিজ্যিক পত্রিকা আমার একটি গল্প সংক্ষিপ্ত করে এবং তথাকথিত ‘অশ্লীল’ জায়গা বলে বেশ কিছুটা বাদ সাদ দিয়ে ছেপে দিয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটাই গা-জোয়ারী, আমার কোনো প্রতিবাদকেই এরা গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। প্রথম কথা প্রতিবাদ করব কোথায়-জনে জনে ডেকে বলা তো সম্ভব নয়। পয়সা নেই যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করব। তাছাড়া এসব ব্যাপার এখন আমার রুচিতে বাধে। তবে প্রয়োজনে জায়গা পেলে আমি প্রতিবাদ করব, নিশ্চিত থাকুন এসবের প্রতিটি ক্ষেত্রেই করব।
সম্প্রতি এসব ছোটখাট ঘটনাকে টেক্কা দিয়ে গেছে একটি ঘটনা। একটা দৈনিক কাগজে (প্রতিদিন, ২৫শে জানুয়ারি, ১৯৯৮) ছাপা হয়ে বেরুল আমাকে নাকি ভুবন মোহিনী না মনোমোহিনী কি একটা একটা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, বিশেষভাবে ব্রাকেটের মধ্যে হাইলাইট করা হল আমি সশরীরে উপস্থিত থেকে সেই পুরস্কার গ্রহণ করেছি। অথচ এসবের আমি বিন্দুবিসর্গও জানি না; কোনো পুরস্কার তো নেওয়া দূরের কথা, এই রকম কোনো সভায় আমি উপস্থিতই ছিলাম না। সমস্তটাই বানানো এবং কুৎসা। তবে প্রতিষ্ঠানের এসব কর্মকা-ে আমি আর আশ্চর্য হই না। এটাই তথাকথিত প্রতিষ্ঠান বা তার ছানাপোনাদের চরিত্র, এভাবেই ক্রমশ তাদের ভালো মানুষের মুখোশগুলি খসে পড়তে থাকে, যখন তারা দেখে তাদের অস্তিত্বের পক্ষে একটা লোক ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে তখন তারা তার বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ায়, মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদ ‘বানিয়ে’ সত্যিকারের পাঠককে বিব্রান্ত করে। লাখের অঙ্কে তাদের পাঠক- আমার এই প্রতিবাদ কতজনের কাছে পৌঁছুতে পারবে? শুধু আমার গুটিকয়েক পাঠক আছেন তাদের জ্ঞাতার্থে খবরটি রাখলাম।
আমি চরিত্র তৈরি করারই বিরুদ্ধেই, কখনও কখনও কিছু কিছু ‘চরিত্র-মুহূর্ত’ তৈরি করি মাত্র, সেখানে প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র তৈরি করতে হবে এসব মাথায় নিয়ে লিখতে বসলে আর যাই হোক লেখাই হবে না। মাপ করবেন, আমার হাড়মড়মড়ি সম্পর্কিত আপনার প্রশ্নটি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।
পথিক : আপনার গল্পগুলোকে অনেক সময় বিভিন্ন পর্যায়ভুক্ত মনে হয়। প্রথমদিকের গল্পগুলোতে যতটা সিরিয়াস বিষয় ভিত্তিক মনে হয় মধ্যবর্তী গল্পগুলো অধিকতর Experiment মনে হয়। আর শেষ দিকে হাড়মড়মড়ি, যে যীশু আমার..., ককীরে লনাং করার মত... ইত্যাদি গল্পগুলোতে নতুনতর বাঁক টের পাই। শেষ পর্যন্ত আপনি কোথায় পৌঁছতে চান?
সুবিমল মিশ্র : আমি ঠিক বলতে পারব না, সম্ভবত আমার গল্পগুলিতে কোনো পর্যায় নেই, একটা স্রোত আছে, কোনোটার থেকে কোনোটা বিচ্ছিন্ন নয়। আমি, আবার, গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ তেমন করে আলাদা আলাদাভাবে দেখি না- সেগুলো গল্প আবার গল্প নয়ও, উপন্যাস আবার উপন্যাস নয়ও, প্রবন্ধ আবার প্রন্ধও নয়। একটা মানুষ যে নিয়ত চিন্তা করে চলেছে, তার লেখাগুলি তার নিজেকে দেখার, নিজের চারপাশ দেখার একটা Thought-Process মাত্র। একটা সময়ে বছর পঁচিশ-ত্রিশ আগে চেষ্টা করেছি ‘অ্যান্টি গল্প’ অ্যান্টি উপন্যাস বলে এগুলোকে প্রচলিত ধারার থেকে আলাদা করে বোঝাবার, কিন্তু সবসময় যে সফল হয়েছি তাও নয়। আমার প্রথম দিকের গল্পগুলো, তখন, যখন লিখেছি, আদৌ গৃহীত হয়নি। এত গালাগালি, নিন্দে মন্দ হয়েছে যে অন্য লোক হলে লেখা বন্ধ করে দিত। আমাকে বয়কট করা হয়েছে, একঘরে করে রাখা হয়েছে। একটা অলিখিত নির্দেশ চালু হয়ে গিয়েছিল যে, কোনো কাগজ সুবিমল মিশ্রের লেখা ছাপলে সে কাগজ রিভিউ হবে না, সেই কাগজের সম্পাদক ও সহযোগীদের গল্প কবিতা তথাকথিত দৈনিক সাপ্তাহিকে ছাপা হবে না। বেশ কিছুদিন ধরে এটা চলেছিল বিশেষ করে ‘অমৃত’ সাপ্তাহিকীটিকে কেন্দ্র করে। এখনকার অনেক তথাকথিত প্রগতিশীল লেখকই নীরবে এসব ব্যাপারে তাদের সম্মতি জানিয়ে রেখেছিলেন। যদি সময় সুযোগ পাই আমার পুরোনো ডাইরি অবলম্বন করে এসব কথা আমি পরে বিস্তারিত লিখে জানাব।
কিন্তু এখন অবস্থাটা কি? যত দিন যাচ্ছে দেখা যাচ্ছে আমার সেইসব নিন্দিত পরিত্যক্ত লেখাগুলি তথাকথিত প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। তাঁরা কখনও প্রকাশ্যে কখনও বন্ধুবান্ধব মারফত লেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে যাচ্ছেন- ‘আর কতদিন একা একা ফাইট করে যাবেন’ চলে আসুন আমাদের সঙ্গে, আমরা আপনাকে সসম্মানে গ্রহণ করব।’ আমন্ত্রণ আসছে রেডিও টিভির থেকেও। কিন্তু এটা আমি ভালো করে বুঝি যে প্রয়োজন হলে প্রতিষ্ঠান সব কিছুকেই গ্রাস করে নিতে চায়, কখনও কখনও নিতে পারেও। আমাকে ভাঙ্গাতে পারে নি কিন্তু আমার অনেক লেখার স্টাইল (বিশেষ করে প্রথম দিককার লেখার) কিছু প্রাতিষ্ঠানিক লেখক রপ্ত করে নিয়েছে। বাধ্য হয়ে বারবার নিজেকে পাল্টাতে হয়, স্টাইল চেঞ্জ করতে হয় যাতে করে আমাকে কোনো নির্দিষ্ট ঘেরাটোপ দিয়ে বাঁধতে না পারা যায়। দেখবেন আমার সাম্প্রতিকতম লেখা একটা ইন্টারভিউ, যেখানে আমি আর নিছক ইন্টারভিউ রাখিনি (অ-য়ে অজগর পত্রিকার সম্পাদক বিপ্লব নায়ক প্রায় ছমাস ধরে দিন নেই রাত নেই- তাড়া দিয়ে দিয়ে এটা করিয়ে নিতে পেরেছে)। লেখাটির নাম ‘তামাকের বাজার বনাম য়ুক্লিডের চতুষ্পার্শ্ব’, যে রকম লেখা ছাপার কথা এই মুহূর্তে কোনো প্রতিষ্ঠান ভাবতে পারে না, বিচিত্র তার গঠন ও গড়ন, HIEROGLYPH বা প্রাক্ভাষাকে অবলম্বন করে নতুন এক দৃশ্যমান চিন্তান-পদ্ধতি। আমি লিটল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নিয়ে ঠিক গল্প নয়, তবে প্রবন্ধ নিবন্ধ জাতীয় বেশকিছু লেখা, ডাইরি জাতীয় লেখা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে মন্তব্যাদি-ও তো করেছি। যেমন ‘হাড়মড়মড়ি’ আমার নতুন কোনো পর্যায় নয় নিশ্চয়ই একটিা বাঁক। কোথায় পৌঁছুব আমি জানি না, কোথাও পৌঁছানো যায় বলে আমি বিশ্বাস করি না, কোথাও পৌঁছুতে হলে একটা স্থির বিন্দু থাকতে হবে তো, আমি চলছি, হয়তো আমার টারগেট-বিন্দুও চলছে... থাক্, আবার ফিলোজফি হয়ে যাচ্ছে...
পথিক : আমরা জানি অমিয়ভূষণ ও কমলকুমার মজুমদার লিটল ম্যাগাজিনের লোক না হলেও প্রতিষ্ঠানের নন। কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক হয়ে আপনি তাঁদেরকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? আপনার কি মনে হয়- এ আন্দোলনটা উনারাই শুরু করতে পারতেন? বা করেছেনও?
সুবিমল মিশ্র : না, ওনারা শুরু করতে পারতেন না। বিরোধিতা আর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা এক জিনিস নয়। ‘বিরোধী লেখক অনেক আছেন, কিন্তু বিশেষ এক জীবন দর্শন প্রতিফলিত না হলে, সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধী না হয়ে উঠলে কখনও তা প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা হয়ে ওঠে না। বিরোধী একটা মানসিকতা ছিল ওঁদের লেখায়, কিন্তু ওনারা কেউ প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছিলেন না, ওঁদের কারোর কাছেই ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা টোট্যাল ব্যাপার’ ছিল না। আবার ওনারা না থাকলে বিরোধী ধারার লেখা কি (বাংলা ভাষায়) জানতেই পারতাম না। তাই এঁদের কাছে আমি ঋণী, বিপুলভাবে ঋণী, এঁদের আমি প্রাথমিকভাবে গুরু বলেই মনে করি।
পথিক : i) কলকাতায় গ্রাফিত্তি- একটি পরিবার থেকে অনেকটা পারিবারিকভাবেই ৩/৪টি পত্রিকা করছে। গ্রাফিত্তির মধ্যে আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্রেজ যতটা লক্ষ্য করেছি সৃষ্টিশীলতার প্রচেষ্টা ততোটা লক্ষ্য করিনি। যতটা না নতুন লেখা তৈরির চিন্তা তার চেয়ে বেশি দু’একজন হাংরি লেখকদের ভিরিয়ে ‘আমাকে দেখুন’ জাতীয় চিৎকার, চেঁচামেচি। আপনার কি তা মনে হয়েছে? গ্রাফিত্তির ম্যানিফেস্টোতে ওরা আপনার একটি সাক্ষাৎকার ছেপেছে। আমি আপনার যতগুলো সাক্ষাৎকার এযাবৎ-কালে পড়েছি- সেটা সবচেয়ে দুর্বল ও খন্ডিত মনে হয়েছে। আপনার কি তা মনে হয়েছে? হলে লেখা ছাপতে দিলেন কেন? গ্রাফিত্তির প্রকাশনায় সুভাষ ঘোষের মলয় রায় চৌধুরীকে নিয়ে একটি খিস্তি-খেওড়ে ছাপা হয়েছে। অথচ ওরা মলয় রায়ের গ্রন্থও করেছেন। এর উদ্দেশ্য কি বলতে পারেন? গ্রাফিত্তির উত্তর পূর্ব এই বিষ অর্জন-এ এবং মেলার বুলেটিনগুলোতে আপনাকে নিয়ে দু’জায়গায় বাজে কথা ছাপা হয়েছে। প্রথমটিতে সুভাষ ঘোষ, অপরটিতে শুভংকর দাশ। আপনি কি বিষয়টি ধরতে পেরেছেন? যদি ধরতে পারেন তাহলে সে কাগজে আপনি লিখছেন কেন? প্রতিবাদ করেছেন কি?
..................................................................................................................
গ্রাফিত্তি ১লা জুন ১৯৯৬ এর একটি সংখ্যার উদাহরণ নিম্নরূপ
‘অনেক বাঁটকো দেঁড়েল আমাদের ঠেক নিয়ে গুসসাও করেছেন বহোৎ, তাদের ধরে দাঁড়ি কামিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রাফিত্তি ঠিক সময় মতো আমন্ত্রণলিপি পৌঁছে দেবে জনে জনে।... আমার খুব ইচ্ছে করছিল বলতে তোমরা কি ছিঁড়েছো হে। এ ন্যাকা বোকা লেখাপত্রের থেকে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে প্যান্ট নামিয়ে যদি বালটাও ছিঁড়তে পারতো তো ক্ষমতা বুঝতাম।... কোনটা প্রাতিষ্ঠানিক আর কোনটা নয় সেটা কাজ দেখে টের পাও। পারবে নাকো বাল ছিঁড়তে, উঠে পড়েছে ভোর থাকতে করে তো কোনো লাভ নেই আর ওসব আতুপুতু চিৎকার প্রচুর শুনেছি এসব অশিক্ষিত, মাগিবাজ, ঢ্যামনা, গায়েগতরে মালগুলো ঠ্যাং চেপে ধরলে সব বাকতাল্লা থেমে যাবে’- গ্রাফিত্তি, ১লা জুন ১৯৯৬
..................................................................................................................
সুবিমল মিশ্র : ব্যক্তিগতভাবে কারোর প্রতি আমার আর কোনো বিদ্বেষ নেই। শরীরের যা অবস্থা ক’দিনই বা বাঁচব! তবে ওদের প্রতি আমার একটাই অনুরোধ ওরা যেন ঝোঁকের মাথায় এমন কিছু করে না বসে যাতে প্রতিষ্ঠানবিরোধী সচেতনতা- যা ক্রমশ পায়ের তলায় মাটি পাচ্ছে- তার ক্ষতি হয়।
ii) প্রচেতা ঘোষের বোবাযুদ্ধে আপনি নিয়মিত লিখছেন। আপনি কি বোবাযুদ্ধকে প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন মনে করেন। যদি না করেন তাহলে কি লেখার কাগজ সংকটের কারণে এটাকে আমরা একধরনের মাইনর স্ট্রোকের মত একটি মাইনর সারেন্ডার বলবো?
সুবিমল মিশ্র : বোবাযুদ্ধ তার ব্যানারে লেখে ‘পণ্যসাহিত্য বিরোধিতার কাগজ’- আর এই পণ্যসাহিত্য বিরোধিতাটি তারা তাদের সাধ্যমত করে তো যাচ্ছে। হয়তো কাগজটির কিছু কিছু লিমিটেশন আছে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সমীপবর্তী আর কোনো কাগজ, দ্বিতীয় কোনো নাম, এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যে আর নেই (অবশ্য আগেই বিজ্ঞাপন পত্রিকাটির নাম করেছি, অতি সম্প্রতি বিপ্লব নায়ক সম্পাদিত অ-য়ে অজগর পত্রিকাটির নাম করতে হয়। যারা ব্যানার হিসেবে এই কথাগুলি ব্যবহার করছে- ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাগজ/মিনমিনে প্রতিবাদমাত্র নয়/ প্রতিষ্ঠানবিরোধী সক্রিয়তায়/অ-য়ে অজগর’
অবশ্যই আমার জানা নেই ভবিষ্যতে এসব কাগজ কোথায় যাবে, কোনদিকে যাবে। বোবাযুদ্ধে আমি লিখি কারণ গত কয়েক বছর ধরে আমার লেখার মত আর কোনো কাগজ নেই। পুস্তকমেলায় টেবিল পাই এদেরই বদান্যতায়, না হলে টেবিল পাওয়ার মত আমার কোনো সুযোগ কোথাও নেই। লালা ও তাপস আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও। ওরা লেখা চায়, বারবার চায়, একটি লেখার জন্য সারা বছর ধরে লেগে থাকে। সত্যি আমাকে ওরা ভালবাসে, ওদের আন্তরিকতার তুলনা নেই।
iii) কোলকাতায় প্রায়ই লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক নির্বাচন করে পুরস্কার টুরস্কার দেয়া হয়। প্রায়শঃ সম্মেলনও হয়ে থাকে। এ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা বা কোনো প্রশ্ন আছে কি?
সুবিমল মিশ্র : না, আমি কোথাও থেকে কোনো পুরস্কার নিইনি, তথাকথিত কোনো সাহিত্য সম্মেলনে যাই না। নিমন্ত্রিত হলে কোনো কোনোভাবে অ্যাভয়েড করে যাই (পারিবারিক বা সামাজিক নিমন্ত্রণেও আমি এটা করি, পরিচিত মহলে আমি অ-সামাজিক লোক হিসেবেই বিশেষভাবে নিন্দিত)। আজ পর্যন্ত আমি গল্প পাঠ, কবিতা পাঠ এর আসরে কখনও যাইনি। এসব আমার ভাল লাগে না। সম্প্রতি আমাকে কি একটা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, আমি নিজে উপস্থিত থেকে তা গ্রহণ করেছি এমন একটি খবর দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটাই মিথ্যে, সাজানো। আমি কখনও কোনো পুরস্কার গ্রহণ করিনি, ঐ রকম কোনো সভায় উপস্থিত হওয়ার প্রশ্নই নেই। বিস্তারিত খবরের জন্য অনুগ্রহ করে অ-য়ে অজগর পত্রিকার প্রতিবাদ ফোল্ডারটি দেখুন।
পথিক : আপনার কি মনে হয় অনেকেই লিটল ম্যাগাজিনকে প্রতিষ্ঠান পাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের সম্পর্কে লিটল ম্যাগাজিনের সতর্ক হওয়ার কি কোনো প্রক্রিয়ার কথা বলবেন?
সুবিমল মিশ্র : এ-তো এক চাক্ষুষ সত্য যে একশ্রেণির লেখক লিটল ম্যাগাজিনকে প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে, করে আসছে, করে আসবে। তাদের ব্যলান্স রাখার কায়দা দেখলেই তা মালুম হয়। মজার কথা, এখন এই নব্বই দশকের মাঝামাঝির থেকে প্রতিষ্ঠানযিবরোধিতাকে মই করে প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার ঠেক তৈরি হয়েছে, হল্লার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। প্রতিষ্ঠানের চোখে পড়ার জন্য ধুন্দুমার লড়াই শুরু হয়ে গেছে, চিৎকার চেঁচামেচি, দু’তিন বছরেই লাইম লাইটের তলায় চলে এসেছে : দেখো হে, আমরাও পাল্টা প্রতিষ্ঠানবিরোধী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি, আমরাই আসল, আমরাই সাচ্চা...। খেলাটা জমে উঠেছে দারুন, আমি নিজেকে আর প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনে করি না- এইভাবে বলে লাইন ক্লিয়ার দিয়ে দিয়েছি, এক পাশে সরে দাঁড়িয়েছি, এবার ট্রিপটিজ শুরু হলো বলে!
এর মধ্যে দু’তিনটি কাগজ আছে, আঙুলে গুনে বলা যায়, সাধ্যমত নাক-কান বুঁজে কাজ করে যাচ্ছে, প্রচার নেই বলে সহজে লাইমলাইটের তলায় এসে পড়ে না, তাদের খুঁজে নিতে হয়, খুঁজে বার করতে হয়।
পথিক : হাংরির মলয় রায় ও সুভাষ ঘোষরাতো একসাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। সুভাষ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। সুভাষ ঘোষরা কি মলয় রায়দের দ্বারা অভিযুক্ত? কেন? হাংরির কি প্রতিষ্ঠানবিরোধি ছিল?
সুবিমল মিশ্র : ওদের মধ্যে মতভেদ আছে। ওটা ওদের ব্যাপার। তবে এইসব কাজিয়া দেখলে দুঃখ হয়। আমি যতদূর জানি মলয় রায় চৌধুরী এদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান পুরুষ, হাংরি জেনারেশনের যা হয়েছে যতটুকু হয়েছে তার বেশিরভাগটাই ওঁর অবদান। হাংরি গদ্যে বিশেষভাবেই বাসুদেব দাসগুপ্ত, সুবিমল বসাক এবং সুভাষ ঘোষের নাম করতে হয়্ এঁদের সম্পর্কে আমার অভিযোগ থাকলেও এদের অবদানকে আমি অস্বীকার করি না। এঁদের প্রতি আমার কোনো বিরূপতা নেই, (বিশেষ করে সুবিমল বসাক আমার বন্ধু স্থায়ীয়, হারাণ মাঝির কাভার-এ সক্রিয় সহযোগিতা ছিল) রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে ‘শ্লোগান সর্বস্বতার’ কথা বলছি না, আদৌ বলছি না, বা পার্টিবাজির কথা বলছি না। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বলতে আমি লেখাকে রাজনৈতিকভাবে অন্বিত হওয়াকেই বোঝাতে চাইছি।
আমাদের দেশে যতগুলি সাহিত্য আন্দোলন হয়েছে তাদের মধ্যে ক্ষুধার্তরাই মুখ্য, এঁরা বেশ কিছুটা কাজ করতে পেরেছিলেন, সাহিত্যের স্বীকৃত আদলে একটা জোর ঘা দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী অ্যাংরি-বিট-গীনসবার্গদের প্রবল অভিঘাত এঁদের মধ্যে এতটাই সক্রিয় ছিল যে দেশের মাটিতে তা শেকড় পায়নি। আর এই ক্ষুধার্তরা ‘ক্ষুধা’ বলতে ঠিক কি বুঝতেন তা তাঁদের লেখা থেকেই বেরিয়ে আসে। দ্বন্দ্ববাদে ক্ষুধা শব্দটির যে বাস্তবতা, তার ধার কাছ দিয়ে ওঁরা গেছেন হয়তো, মূলভূমি স্পর্শ করেননি। একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধীর চোখে ক্ষুধা ক্ষুধাই- এর কোনো দ্বিতীয় বাস্তবতা নেই, তৃতীয় বিশ্বের অগুনতি অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষের কাছে ক্ষুধা এক বাস্তব সত্য। ষাট-সত্তরের মনুষ্য তৈরি দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র রেখেই তা তৈরি হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আর এক কথা, অনেকে বলেন ক্ষুধার্তরাই প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী। আমি অস্বীকার করি না, কোনো কিছুতে প্রথম হবার চেষ্টা আমার ধাতে নেই, কিন্তু হাংরিরা তো আগে প্রতিষ্ঠানবিরোধী পরে হাংরি একথা বলেন নি, এখনও বলেন না। তাহলে তাঁদের আন্দোলন প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতো, হাংরি হতো না।
পথিক : আপনার গল্পে, উপন্যাসে ঝবী এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। অনেকে আপনার লেখাকে ঝবী দোষে অভিযুক্তও করে থাকে। অনেকে আবার আপনার এ প্রবণতাকে বুনুয়েল দ্বারা প্রভাবিত বলেও আখ্যায়িত করেন। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?
সুবিমল মিশ্র : সেক্স এর জন্য সেক্স আমি কখনও ব্যবহার করিনি, সচেতনভাবে, কোনো-না-কোনো ভাবে তা আমার শ্রেণি ঘৃণার প্রকাশই। সেক্সকে সেক্স দিয়েই আঘাত করেছি, করে এসেছি, করতে চেয়েছি এতকাল। অনেকদিন আগে ‘সুবিমলের বিরুদ্ধে সুবিমল এবং উস্কানিমূলক অনেক কিছুই, আপাতভাবে’ বইটিতে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে আমি এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করেছি।
আমি সর্বদা এর প্রয়োগ দিয়ে মাথা ঘামাই, সে প্রায় ক্ষুরের উপর দিয়ে হাঁটা, প্রভাব ট্রভাব নিয়ে ভাবি না, ওসব সমালোচকেরা দেখবেন। সম্প্রতি, হাড়মড়মড়ির সময় থেকে, এসব নিয়ে আরো কিছু কথা হয়তো জমা হয়েছে, দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবেও, সুজয় মোদক এ বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন, এ নিয়ে স্বতন্ত্র কোনো লেখায় কিছু হয়তো বলব, এখানে সে সবের ডিটেলস অবান্তর হয়ে যাবে।
আর শুধু বুনুয়েল-এর দ্বারা প্রভাবিত হবে কেন, আমি তো ডি-সাদ্ পড়েছি, পড়েছি ক্যাথিয়াকার, পড়েছি বাতাই-ও। আসলে প্রভাবিত হওয়া সম্পর্কে সমালোচকরো বলবেন, আমাকে কখনও কখনও কেউ কেউ ভাবিয়েছেন এই যা।
পথিক : রামায়ণ চামার কি আপনার একটি প্রতীকী চরিত্র, যা বুর্জোয়া ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী চরিত্র। অথবা স্পষ্ট করে বললে আপনি কি রামায়ণ চামারের মধ্য দিয়ে আপনাকেই রিফ্লেক্স করেছেন?
সুবিমল মিশ্র : আমি এসব কিছু লিখিনি... আপনার কি মনে হচ্ছে?....
পথিক : আর বিদেশিরা হু হুর করে ঢুকে পড়ছে আমাদের দেশে। বিদেশি অনুপ্রবেশ রোধে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত বরাবর কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হচ্ছে। আগে কংক্রীটের প্রাচীর তোলার কথা হয়েছিল- সে অনেক খরচাপাতির ব্যাপার। বদলে ৩ হাজার ৩শ কি. মি. কাঁটাতারের বেড়া-
রং যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন- তে আপনি এ কাঁটাতারের বেড়া বা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার সম্পর্কে কি বলতে চেয়েছেন?
সুবিমল মিশ্র : বাংলাদেশীদের আমার বিদেশি মনে হয় না। তারা আমার আত্মার আত্মীয়, তথাকথিত ভারতীয়দের, হিন্দী-হিন্দু-ওয়ালাদের থেকে তাদের আমি অনেক-অনেক বেশি আপনজন মনে করি। যাঁরা, যে-সব বাংলাদেশি সব হারিয়ে এদেশে এসেছেন, এসে পড়েছেন- তাদের প্রতি বিজেপি নামক ‘তালিবানরা’ যে অলিখিত যুদ্ধ ঘোষণা করে আর শাসক-পার্টি আর তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা-মায় সি পি এম পর্যন্ত যেভাবে এসব চক্রান্ত ও চালের বিরুদ্ধে কিছু না বলে মুখ বুঁজে আছে- রাজনৈতিক ফায়দা তোলার তালে রয়েছে- সে-সবেরও আমি তীব্র প্রতিবাদ করি। এই কর্তৃত্ব লোভী ভোট-কাঙাল রাজনীতিবিদদের হাতে পড়ে একটা জাতি- গোটা একটা জাতি বলতে গেলে উদ্বাস্তু হয়ে গেল।
না, দুই বাংলার মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য আমি শুধু প্রতিবাদ করি না ঘেন্নায় আমার বাক রোধ হয়ে আসে, এদেশের মানুষ বলে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ হয়। উপায় থাকলে অন্য কোথাও, অন্য কোনো দেশে চলে যেতাম।
......................................................................................
ডাইরি থেকে একটি অংশের উদ্ধৃতি দিচ্ছি
আমি বাংলাকে ‘গো-বলয়ের’ একটি স্থায়ী উপনিবেশ করার বিরুদ্ধে। এই গো-বলয় তথা পশ্চিম ভারতের সমৃদ্ধির একটা বড় অংশই যাচ্ছে বাংলা এবং পূর্ব ভারত থেকে। নেহেরু থেকে শুরু করে আজকের সোনিয়া গান্ধী পর্যন্ত (ভায়া বিজেপী) দিল্লীওয়ালারা কোনো কালেই বাংলাকে বাঁচায়নি, বাঁচাতে চায়নি বরং প্রকারন্তরে শোষণ করেছে এবং সুযোগ পেলে সারা বিশ্বের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। বাঙালি জাতির আট কোটি মানুষের ভাষাকে এরা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে দেখিয়ে করুণা করে যা ভাবলে মাথায় রক্ত উঠে যায়। হিন্দীকে ‘জাতীয় ভাষা’ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার স্পর্ধাকে আমি সহ্য করতে পারি না। আর পাওয়ার এর পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হিন্দি এভাবে আমাদের উপর চেপে বসার সাহস পেতো না- ‘হিন্দী হিন্দু সমার্থক’ জাতীয় অদৃশ্য ‘বর্গী’ সাম্রাজ্যবাদের ধ্বজা উঠত না। গো-বলয়ে আর মারাঠী বর্গীরা (মুম্বাই যার মূল কেন্দ্র) সারাটা বাংলাকে গ্রাস করে নিল, বাংলা ভাগ হল মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন ক্ষমতালোভী নেতার স্বার্থে। পাকিস্তানীয় উদ্বাস্তুদের যেভাবে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে, যেভাবে তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে তার অর্ধেকও কোন বাঙালি উদ্বাস্তু পায়নি, কেন তাদের গরু-ছাগলের মতো দত্তকারণ্যে পচে মরতে হল, হয়েছে- তার জবাব কে দেবে? এসব নিয়ে অনেক কথাই বলা যায়। গাঙ্গোত্রী থেকে বেরিয়ে আসা জলসম্পদের সত্তর ভাগই, ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে লিফট করে নিচ্ছে। ফেব্রুয়ারি মে মাসের সুখা মরশুমে, লিন-সিজনে গঙ্গার জল আটকে উত্তর-পশ্চিম ভারতকে শ্যামল করা হচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক পার্টিগুলোতে দিল্লী দখলের প্রতীক্ষায়। পার্টির স্বার্থে, রাজনৈতিক স্বার্থে বাঙালি জাতির শেষ সম্বল বাংলা ভাষাটাকেও যখন হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ ভুলিয়ে দিতে চায় তখন তারা রা কাড়ে না। আসাম সহ সমগ্র পূর্বভারতে প্ল্যান করে, বছরের পর বছর ধরে বার বার ‘বাঙালি খেদাও’ চলছে, চলছে বাঙালি নিধন। এ ব্যাপারে দুএকটি মিউ মিউ শব্দ ছাড়া এদের মুখ থেকে কোনো কথা শোনা যায়নি, শোনা যায় না। বাংলার সম্পদের আশি শতাংশ বাংলার স্বার্থে খরচ করতে হবে- এ শ্লোগান কোনো রাজনৈতিক দল তুলেছে কি? তুললেই নাকি আমরা অচ্ছুৎ হয়ে যাব, সামগ্রিক ভারতীয়ত্ব উপেক্ষা করে সংকীর্ণ প্রাদেশিকতায় আশ্রয় নেব। আমার এইসব কথা শুনে কেউ কেউ আমাকে ফ্যাসীবাদও বলতে পারেন, আমি গ্রাহ্য করি না। একসময় পশ্চিম বাংলায় বাংলা কথা বলাটাও না বারণ হয়ে যায়- বাতিল হয়ে যায়- আমি বাড়িয়ে বলছি না- এ ধরনের অবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে- তৈরি হয়ে গেছে, হয়তো, আমাদের অজান্তে...
......................................................................................
পথিক : আমাকে গুলি করে মারতে পার কিন্তু আমি আত্মসমর্পণ করবো না। আমি শোষিতের জন্য লড়াই করি, আমি মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাই। এই জমিন একদিন যে চাষ করতো তার হবে। যদি তোমরা আমাকে মেরেও ফেলো তবু এ ঘটবেই। আমার পেছনে আমার মতো আরো আরো মানুষেরা লাইন দিয়ে আছে। তারা আসবে- আসবে আসতেই থাকবে। এটাই কি রামায়ণ চামারের- আপনার শেষ কথা?
সুবিমল মিশ্র : কার মনে হয়?...
পথিক : কণ্ঠপালক ওড়া-তে মানিকের তিনটি উপন্যাসকে ব্যবহার করা হয়েছে- মানিকের পুরুষ চরিত্র তিনটি, হেরস্ব-শশী-রাজকুমার-এটা কেন করেছেন? মানিক বন্দোপাধ্যায়ের উপর কোনো দায়িত্ব না আপনার খেয়াল?
সুবিমল মিশ্র : ওটা উপন্যাস লেখার একটা পদ্ধতি, মানিক বন্দোপাধ্যায়কে তাঁর চরিত্ররাই গড়ে নিতে চেয়েছে নতুন করে, সেক্সপীয়রকেও। লেখক সাগ্রহে দেখছে পদ্ধতিটা, যাতে ওসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, আবার উল্টোমুখে ঐ পদ্ধতিটাই পরীক্ষা করতে করতে আপন অবস্থান খুঁজে পাবার আরো অনেক জিনিস আছে ওখানে, ঔ লেখায়...
পথিক : খবর নিয়ে জেনেছিলাম- তার পছন্দের মানুষ, ভেরুয়া, সেই অনাহুত সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখা বন্ধ করার জন্য মেয়েটির তলপেটে এক লাথি মেরেছিল। তার আশংকা- সন্তানের মা হয়ে গেলে মেয়েদের বাজার দর কমে যাবে। -তারপর স্থানীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে পাড়ার বস্তির বাসিন্দাদের বসচা হয়। একটি শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে ঘটনাটি ঘটে।... লেখকটি কি আত্মহত্যা করেছিল? হয়তো তার সৃষ্টি চরিত্রগুলোর কাছে সে হারতে চায়নি। জীবিত থাকাটাই সম্মানে লেগেছিল তার হয়তো। নাকি অন্য কিছু?
সুবিমল মিশ্র : মাফ করবেন, প্রশ্নটি ঠিক ধরতে পারলাম না। সম্ভবত এখানে মৌলবাদে’র প্রশ্নটি তোলা হয়েছে। আমার কাছে মৌলবাদ মৌলবাদই- এক সঙ্গে আমাদের লজ্জা ও পাপ দুইই। একদল মসজিদ ভাংতে যায়, অন্যদল মন্দির। ধর্মের নামে এরা মানুষকে শুধু বিভ্রান্ত করেনা, প্রতারিতও করে। এ নিয়ে অনেক অনেক কথা বলার আছে আমার, কিন্তু এখানে নয়, এভাবে সাক্ষাৎকারে নয়...
পথিক : আসলে লেখাটাতো লেখক ও পাঠক দুজনের। দু-তরফ একসঙ্গে না এগোলে যে লেখাটাই এগুবে না।... কায়দাটা ক্যামেরা ব্যবহারের মতোই। ক্যামেরা শুধু লক্ষকেই ধরে না, লক্ষকে আয়তন দেয়ার জন্য উপলক্ষ্যকেও ধরে। ঢুকে পড়ে প্রত্যক্ষ অপ্রত্যক্ষ অনুষঙ্গ। সব জড়িয়ে তখন অন্য মাত্রা পায়। স্থান-কাল-পাত্র সব ছড়িয়ে ছাড়িয়ে অন্যত্র যেতে থাকে- আপনি কি পাঠককে উপন্যাস লেখা শেখাতে চান?
সুবিমল মিশ্র : আজ্ঞে না, আমি পাঠককে, উপন্যাস লেখা শেখাতে যাব কোন দুঃখে। এমন ধৃষ্টতা আমার নেই। আমার অনেক ‘লেখায় লেখার-বিষয়ের’ সঙ্গে ‘লেখার-পদ্ধতিটাও’ জড়িয়ে যায়, আমার স্টাইলের অংশ। আমার নিবিষ্ট পাঠকেরা সেভাবেই তো আমাকে জানেন। আবার আমার উপন্যাসগুলি পাঠের সময় পাঠকের ভূমিকা কখনো কখনো লেখকের থেকেও বেশি। লেখকের লেখা আর পাঠকের প্রতিক্রিয়া দুটো মিলেই উপন্যাসটি পূর্ণ হয়ে উঠার সম্ভাবনার দিকে যায়, তাঁদের হাতে কলমে সৃষ্টির জন্য বইতেই কিছু ফাঁকা জায়গা রাখা থাকে। ঐ ধরনের পাঠকের, বাস্তব ও জ্যান্ত পাঠকের- যাদের অস্তিত্ব না থাকলে আমি লিখতে পারতাম না।
পথিক : আপনি রবীন্দ্র সদনের পাশাপাশি এক সমান্তরাল প্রলেতারিয়েত সংস্কৃতি ঋত্বিকসদনের প্রত্যাশা করেছেন। যা আপনার লেখায় দাবি থেকে মিছিলে রূপ নিয়েছে- রবীন্দ্র সদন কী তাহলে বুর্জোয়া সংস্কৃতির ধারক।
সুবিমল মিশ্র : না, রবীন্দ্রসদনকে আমি ‘বুর্জোয়া সংস্কৃতির ধারক’ এইভাবে মনে করি না, তবে কোথাও না কোথাও, আমাদের এ বাংলায় তা প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হয়ে পড়ে এবং নির্মম সত্য। প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির ফোড়েরা যতনা রবীন্দ্রনাথ পড়ে, ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ করতে, কাজের বেলা কিন্তু উচ্ছ্বসিত হয় বলিউডের সিনেমা ও তার গান নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে বিশেষ মর্যাদা পান, এ বিষয়ে আমার অনেক কথাই বলার আছে, তবু রবীন্দ্রনাথের ছবি, গান ও ছোটো গল্পকে বিশেষ ভাবেই শ্রদ্ধা করি। রবীন্দ্রনাথের গান আমার প্রাণের গান, আমার আত্মার আত্মীয়। রবীন্দ্রসদনের পাশাপাশি ‘নন্দন’ নয়, প্রলেতারিয়েত সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে নন্দনের নাম বদল করে ‘ঋত্বিক সদন’ হোক এটা চেয়েছি, স্পষ্ট করে চেয়েছি।
আপনি বোধ হয় ঋত্বিক ঘটকের উপর রচনাটির কথাই বলেছেন। এ সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলে নিই। অনেকদিন আগে, গোড়ার দিকে, আমি ঋত্বিকের উপর একটা রিসার্চমূলক কাজ করতে চেয়েছিলাম, পরে সমস্ত পরিকল্পনাই পরিত্যক্ত হয়, কোথাও কোথাও প্রাথমিক স্কেলিটনটা হয়তো থেকে গেছে। লেখাটির পেছনে দীর্ঘ সময় গেছে, মূল অংশটায় দেখতে পাবেন ঋত্বিকের উপর এ যাবৎকালে আলোচনাগুলো বাঁ-দিকের কলামে জড়ো করে ডানদিকের কলামে তা বিশ্লেষণ করতে চেয়েছি, বিচার করতে চেয়েছি। কিন্তু তাতে নতুন কথা কিছুই প্রায় বলিনি, তবে অমীমাংসিত কিছু কিছু বিষয়ের দিকে একটা অনির্দিষ্ট ধাবমানতা রয়েছে, আবার রয়েছে ঋত্বিককে ঋত্বিক-চিন্তা পদ্ধতি দিয়ে বিশ্লেষণ করে কিছু একটা হাতড়ে বেড়ানোর চেষ্টা। সেই অর্থে আবার এটা প্রবন্ধই নয়, নয় কারণ প্রবন্ধের মতো এর কোনো প্রকৃষ্ট বন্ধন নেই, কোনো প্রচলিত আদলে এটা তৈরি হয়নি।
কিন্তু এটুকু লেখাটির কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে প্রবন্ধ লেখার ভেতর দিয়ে আমি এক ধরনের প্রতিষ্ঠানবিরোধী পরীক্ষা করতে চেয়েছি (বিপ্লব নায়ক তাই এই প্রবন্ধটিকে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী দৃষ্টিতে লেখা প্রবন্ধ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে, আমার অন্য কোনো কোনো পাঠকেরও এই অভিমত)। লেখা তো লেখাই, লেখা সবসময় অক্ষরেও বাক্যে নিবন্ধ থাকে, এবং তা ‘বক্তব্য’ বা ঐ রকম কিছু নিয়ে সমাহিত থাকে লেখার মধ্যে। আমি এ লেখায় চেয়েছি, লেখাটি শুধু বক্তব্যে সমাহিত না থেকে তা ‘অ্যাকটিভ’ হয়ে উঠুক মারকুটে হয়ে যাক, চিৎকার করে প্রতিবাদ করুক। লেখাটি আর লেখা নয়, শুধুমাত্র অক্ষরগুচ্ছ নয় সে একটা জ্যান্ত প্রতিবাদ হয়ে যাক। অন্যান্য প্রবন্ধের সঙ্গে এটাই সম্ভবত এই লেখাটির মূল পার্থক্য।
পথিক : অমিয়ভূষণ কিংবা কমলকুমার সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখক ছিলেন না কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকও ছিলেন না। আপনার লেখায় মাঝে মধ্যে আক্ষেপ উঠে আনন্দরা এদের লেখা ছাপেননি। এ আক্ষেপ কি এদের অনুগ্রহ প্রত্যাশাকে বুঝায় না? আপনি কি মনে করেন আনন্দ যদি ওদের ছাপতো তাহলে আমাদের আজকের অহংকার থাকতো? আমরা কি এই ফলে আক্ষেপ করতে পারি যে আনন্দ সুবিমলকে ছাপে না। ছাপলে কি আপনি প্রতিবাদ করবেন না?
সুবিমল মিশ্র : কমলকুমার মারা গেছেন অনেকদিন, অমিয়ভূষণ এখনও বেঁচে আছেন। মৃত্যুর পর কমলকুমারের বই প্রতিষ্ঠান ছেপেছে নিজেদের ইমেজ বাড়াতে। অমিয় ভূষণের একখানা চটি বইও বের করেছে। কিন্তু তাঁকে ঔপন্যাসিক হিসেবে (আমি ব্যক্তিগতভাবে জীবিত ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য বলে মনে করি) কোনো স্বীকৃতি দেয়নি, যিনি আশি বছর বেঁচে আছেন এবং এখনও লিখছেন তাঁর একটা উপন্যাস ছাপার সৌজন্য আনন্দবাজার কোনোদিন দেখায়নি। কমলবাবুর বই ছাপালেও (মৃত্যুর পর) তাঁর গ্ল্যামারটিকেই শুধু কাজে লাগিয়েছে। আনন্দবাজার কোনোদিনই কমলবাবুর ধরনের লেখাকে স্বীকার করেনি, স্বীকার করতে পারে না। আপনি নিশ্চিত থাকুন কেন কোনো তথাকথিত বড় মেজো- সেজো প্রতিষ্ঠানই সুবিমলকে ছুঁতে পারবে না। ভবিষ্যতে যাতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা করে যাচ্ছি।
আসলে আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানের লোকজনেরা কিঞ্চিৎ ভোদাই মার্কা, আর আনন্দ কোম্পানি তো ঐ ভোদাইদের স্বর্গরাজ্য। প্রতিষ্ঠানের একটা ফ্লেকসিবিলিটি রয়েছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী ওরা নিজেদের পাল্টে ফেলতে পারে, বিদেশের প্রতিষ্ঠান হলে কমলকুমার, অমিয়ভূশষণের মত লেখককে অনেকদিন আগেই গিলে ফেলত, প্রতিষ্ঠানের অংশ করে নিতে পারত। এর বিরুদ্ধে একটি মাত্র উপায়ই আছে, একটি মাত্র উপায়, প্রতিষ্ঠান যতটা দ্রুত গতিতে নিজেকে পাল্টে ফেলতে থাকবে, প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতাকেও তার থেকে দ্রুত গতিতে আবর্তিত হতে হবে। ধরুন ওরা আমার হারাণ মাঝির লেখাগুলোকে, এতদিন পরে, তিরিশ বছর পরে অ্যাকসেপ্ট করতে শুরু করল, তখন কিন্তু আমি আর হারাণ মাঝি জাতয়ি কিছু লিখছি না, আমি লিখছি ‘কণ্ঠ পালক ওড়া’। হারাণ মাঝি পারলেও কণ্ঠ পালক ওদের কণ্ঠে আটকে যাবে, গিলতেও পারবে না, ওগরাতেও না। সুতরাং এই মুহূর্তে আমার কোনো ভয় নেই। তবে আরও তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছর পরে প্রতিষ্ঠান নিজেকে পাল্টে পাল্টে এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে পারে যখন কণ্ঠ পালককেও অ্যাকসেপ্ট করে নিতে চাইবে। হলেও হতে পারে এমন অবস্থা যখন আমি থাকব না। তবে কিছুদিন যদি বাঁচি কণ্ঠ পালকের থেকেও এমন বাঁশ তৈরি করে রাখব যেটা প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করতে গেলে হাড়ে হাড়ে টের পাবে প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা কি বস্তু! ...প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে গ্রাস করে নিতে পারে, আর এসব সকতর্ক না হলে আমাদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে, পরিবর্তিত হতে না পারলে শুধু হাত কামড়াতে হবে...
......................................................................................
এমন কিছু নিয়ে, আরো বেশি কিছু নিয়ে ডায়েরি থেকে
একটু বিস্তৃতভাবেই উদ্ধৃতি দিচ্ছি
বিরোধিতার একটা মাত্রা সব সময় সব দেশে ছিলই, কিন্তু বিরোধিতা মাত্রই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নয়, বিরোধিতার মাত্রাগুলি যখন ঘনবিষ্ট হয়ে সংহত হয়, যখন একটা জীবনদর্শনের রূপ পায়, তখন তা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা হয়ে ওঠে- প্রতিবাদ ক্রিয়ার প্রবলতম মাত্রায় সে নিজে নিজেই সক্রিয়। এই বিশিষ্ট জীবনদর্শন-অন্বিত-সক্রিয়তা ছাড়া বিরোধিতা বিরোধিতাই- তাকে ভেঙ্গে দেওয়া যায়, কিনে নেওয়া যায়- চুপ করিয়ে দেওয়া যায়ই। এই বিরোধিতার ক্ষেত্র বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিঘাতে বিভিন্ন মাত্রায় হয় এবং সচরাচর এই বিরোধিতাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলে ভাবা হয়, হয়ে থাকে। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা, যে কোনো বিরোধিতাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা নয়, হতে পারে না, তাকে একটি জীবনদর্শনের সঙ্গে অন্বিত থাকতে হবে আর এই অন্বয়ের সূত্রে সক্রিয়ও। তখন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা কথাটি আর দুটো আলাদা শব্দ থাকে না, হাইফেন জুড়ে দেওয়া শব্দও নয়, একটি মাত্র শব্দে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা’ তার দার্শনিক রূপ নেয়, মাত্রা পায় নিজেকে বিপন্ন করে বিরুদ্ধতার সামগ্রিকতা পালন করার ভেতর দিয়ে। প্রসঙ্গত : কমলকুমার বা অমিয়ভূষণের নাম এসে যায়। তাঁরা প্রচলিত যে সাহিত্যধারা, তার বিরোধী ছিলেন বা বলা ভালো তাঁদের লেখায় প্রচল সাহিত্য দারার মধ্যেই অন্যকিছু অন্যতর কিছু করার চেষ্টা লক্ষিত হয় কিন্তু প্রচলিত সাহিত্য ধারার বিরুদ্ধে কিছু করার ঝুঁকি তাঁদের মধ্যে ছিল না, তাঁরা সাধারণ অর্থে বিরোধী কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধী নন। কমলকুমার মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন, বেঁচে থাকলে এখন তাঁর গ্লামার, প্রতিষ্ঠান তাঁকে সহজেই গলাধঃকরণ করে নিতে পারতো, যেমন পেরেছে অমিয়ভূষণকে। অমিয়ভূষণকে আমি লেখক হিসেবে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা করি, আমার বিচারে তিনি জীবিত ঔপন্যাসিকদের মধ্যে প্রথম স্থানটি অধিকার করে নিয়েছেন অনিবার্যতায়, কিন্তু প্রতিষ্ঠান তাঁকে এঁটো করে দিয়েছে এ সত্যটাও তো মিথ্যে নয়। এঁটো করে দিয়েছে অথচ স্বীকার করেনি। না হলে তাঁকে দিয়ে পূঁজো সংখ্যায় একটা উপন্যাস লেখাতে পারে না সাগরময়রা? আনন্দ থেকে তাঁর একটা চটি প্রবন্ধের বই বের করেছে যেন অমিয়ভূষণ ঔপন্যাসিক কথাশিল্পী নন, আমাদের সময়ে জীবিত প্রধান ঔপন্যাসিক নন, আদৌ। সন্দীপনও এই ধারার মধ্যে পড়েন, তাঁর লেখাপত্র প্রচলিত স্রোত থেকে আলাদা করা যায়, কিন্তু তাঁর লেখা প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে, বিরুদ্ধতায় একরোখা বলা যায় না। তাঁর মধ্যে যে বিরোধিতার মাত্রাগুলি ছিল, তা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছিল না ঠিকই, কিন্তু মাত্রাগুলির প্রাবল্য অস্বীকার করার উপায় নেই, বিশেষত ‘সোমেন পালিতের বৈবাহিক’- জাতীয় আলোচনায়; কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখের যে লেখক জীবনের পরবর্তী পর্যায়ে তিনি এ সবকে আর স্বীকার করলেন না, বরং এড়িয়ে গেলেন। দেশ-এ তিনি সাকুল্যে কটা লেখা লিখেছেন এগুলো প্রধান বিবেচন্য নয় ‘দেশ’এ লিখেও যে তিনি তাদের কাছে পাত্তা পাননি এটাই বড় কথা। তাই এক বিচিত্র যুক্তিতে আনন্দবাজার তার কাছে প্রতিষ্ঠান, কিন্তু আজকাল নয়, সংবাদ প্রতিদিন নয়, পুরস্কার-টুরস্কাগুলো তো নয়ই। সাহিত্য-সংবাদের ছোটো ছোটো ঘাঁটিগুলিও যে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না, নিজেদের স্বার্থে নিজস্ব আর একটা গোষ্ঠীর তৈরি করে, নাম-যশ-টাকা পাইয়ে দিয়ে তাদের পুষতে চায় নামের গ্লামারটিকে পুঁজি করে, এসব তিনি আর কবে বুঝবেন!
প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা মূলত তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক পরিবেশ-জাত একটি বোধ- একটি প্রেক্ষণ। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব- যাঁদের এ জাতীয় ঔপনিবেশিক মানসিকতার অভিজ্ঞতা নেই- যাঁদের দেশে একটি কি দুটি সংবাদপত্র বা তাদের পেটোয়া দু-চারটি প্রকাশনসংস্থা ফড়ে হিসাবে সমগ্র সাংস্কৃতিক জগতে দাপিয়ে বেড়ায় না, নিয়ন্ত্রিত করে না- একমাত্র আমরাই একসেবা দ্বিতীয়ম- আমরা যা ছাপব সেটাই লেখা- আমাদের বাইরে আর কিছু নেই, কেউ নেই- এমন অভিজ্ঞতা তারা কখনো প্রত্যক্ষ করেনি। তাদের দেশের শয়ে শয়ে সংবাদপত্র- হাজার হাজার প্রকাশন সংস্থা- একজন দু’জন সমগ্র সাংস্কৃতিক জগতের ওপর ছড়ি ঘোরায় না, ঘোরাবার স্পর্ধা দেখায় না। একটি প্রকাশন সংস্থা রিফিউজ করলে প্যারালাল আর একটি প্রকাশন সংস্থা তাকে সাগ্রহে গ্রহণ করে। আর এই অবস্থাটা আছে বলেই একো বা ফুকো-র কঠিনতম বইগুলোও বেস্টসেলার হয়ে যায়। লেখককে প্রকাশের কথা আদৌ ভাবতে হয় না প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বে। আমাদের এখানে যে এতো অজস্র লিটল ম্যাগাজিন যা আসলে নিজেকে প্রকাশ করার একটা অলটারনেট ধারাকে তুলে ধরার মতো পত্রিকা বা প্রকাশন সংস্থা বেশি না হলেও আদৌ অপ্রতুল নয় প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বে। আরো অনেক কথা বলা যায়... বলতে চাইছি এই সবের জন্যই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পুষ্ট দেশের একেবারে নিজস্ব প্রত্যয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সমূহ শেকড় এদেশের মাটিতে প্রোথিত, তা ধার করা নয়, আমদানী করা নয়।
পথিক : আপনি ইদানিং বলছেন- নিজেকে বিপন্ন করার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র পাকা হবে। কিন্তু আপনার কি মনে হয় আপনি একজন ব্যক্তি নিজেকে বিপন্ন করে লিখেন কিন্তু নিজেকে বিপন্ন করে কি একটি কাগজ তৈরি হয়েছে?
সুবিমল মিশ্র : না। আমি নিজেও তো পারিনি, অন্যকে দোষ দেব কি-আর আমার সবচেয়ে ত্রুটি আমার কোনো সংগঠন শক্তি নেই। লোককে টোপ দেখিয়ে দলে টানার চেয়ে ভাগিয়ে দিতে ভালবাসি, শেষকালে নাছোড়বান্দা কেউ কেউ থেকে যায়, এইভাবেই বিপ্লব নায়ক থেকে গেছে... অ-য়ে অজগর...
আসলে নিজেকে বিপন্ন করতে হয় প্রতিপদে, সামাজিক দিক থেকে তো বটেই সাহিত্য সংস্কৃতির দিক থেকেও। সামাজিক দিক থেকে যেহেতু প্রচলিত মূল্যবোধগুলিতে তুমি বিশ্বাস রাখ না তাই এগুলিতে যত সীমিতভাবেই হোক না কেন তোমাকে প্রতিবাদ রাখতেই হয় এবং সমাজ সংসার পরিবার থেকে একঘরে হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে পুরোপুরি। আমি গতপ্রায় তিন দশক ধরে কোনো রকম সামাজিক অনুষ্ঠানে যাই না, কোনো আত্মীয় বাড়িতেও না। এইসব মধ্যবিত্তীয় ন্যাকামি (যাকে ভদ্রলোকরা সামাজিকতা বলে) সহ্য হয় না। ফলত অসামাজিক, ম্যানার জানে না, এসব অভিযোগতো শুনতেই হয়, একধরনের সামাজিক বয়কটের মুখেও পড়তে হয়। আমার আত্মীয় স্বজন, এমন কি প্রতিবেশীরা পর্যন্ত আমাকে পারতপক্ষে অ্যাভয়েড করে চলে। এখন আর কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ডাকে না, আমিও আবার আমার বাড়িতে কোনোরকম লোক দেখানো সামাজিক অনুষ্ঠান করিনা, করিনি। বাবার মৃত্যুর পর, হিন্দুমতে যা করা উচিত, সেসব শ্রাদ্ধ-শান্তি করিনি, গয়ায় বেড়াতে গেছি কিন্তু পি- দিইনি, মেয়েকে বিভিন্ন দিক থেকে অনুরোধ উপরোধ আসা সত্ত্বেও, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, ইংরাজী মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিনি। দেশের হাজার হাজার সাধারণ ছেলে মেয়ের যা হয় তারও তাই হবে, আমি বন্ধু-বান্ধবদের ধরে ভালো ইস্কুলে ভর্তির কোনো সুযোগ নিইনি, নিতে পারব না। হ্যাঁ, আমার কাছে ক্যারিয়ারের নেশা ড্রাগের নেশার থেকেও সাংঘাতিক। আবার চেষ্টা করেছি বাড়িতে ঝি-জাতীয় মহিলার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ তুলে দিতে। নিজের কাজ- রান্নাবান্না করার থেকে বাসন মাজা সবটা নিজে করা যায় কিনা পরখ করে দেখতে চেয়েছি, নিজেদের কাজ অন্য অভাবগ্রস্ত কোনো মেয়েকে অল্পস্বল্প টাকা দিয়ে করিয়ে নেওয়াটাকে আমি একধরনের সামাজিক শোষণ বলে মনে করি-যা প্রাতিষ্ঠানিক মানসিকতার একটা বড় ব্যবহারিক দিক। হ্যাঁ, এখন, বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে চালাচ্ছি। লেখালিখির ব্যাপারে তো সারাজীবন ঝুঁকি নিয়েই থাকি, বাণিজ্যিক কাগজগুলিতে লিখতে চাইনি এটা বড় কথা নয়, তাদের উপেক্ষা করার মানসিকতাও আমি আমার ব্যবহারিক জীবন থেকে আহরণ করি- করে থাকি।
পথিক : আপনি বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা টোট্যাল ব্যাপার। প্রকৃতপক্ষেই একজন মানুষ টোটালি প্রতিষ্ঠানবিরোধী হতে পারে কি? -আপনিও কি পেরেছেন?
সুবিমল মিশ্র : আর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা একটা টোট্যাল ব্যাপার বলতে আমি বুঝিয়েছি, সব কাজেই, জীবন-যাত্রায় এই বিরোধিতার কিছু না কিছু ছাপ থাকবে। মুখে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলছি, নামটি ভাঙিয়ে সাহিত্যের বাজারে ঢুকতে চাইছি অথচ প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধগুলি আমাকে ঘিরে রয়েছে, তা হয় না। সেগুলোকে প্রতিমুহূর্তে ভাঙা দরকার। অন্তত ভাঙার একটা সক্রিয় তাগিত তার মধ্যে থাকবে এটা আশা করা যায়। অনেক দিন আগে বিয়ে জাতীয় একটা ব্যাপার করলেও নিজের বাগিতে বিয়ের না ধর্মীয়, না সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানই করিনি। অথচ সেদিন দেখলাম একজন স্বঘোষিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী বিয়ে করল ধুমধাম করে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কবি ও কবিনী, ঝলমলে পার্টি, বিরাট জৌলুস, শহরের টপ টপ ব্যক্তিরা নিমন্ত্রিত-আমন্ত্রিত, বিয়ের পর পরই নবদম্পতি মিলে, পৈত্রিক একটা বাড়ি তো আছেই- বাপের জমানো টাকা আছে- বড় রাস্তার উপর চালু দোকান আছে- স্ত্রীর নামে একাধিক ফ্ল্যাট বাড়ি আছে, কলকাতার উপরে আর টাকা থাকলে কী-না করা যায়। কারোর নামে কুৎসা করার জন্য আমি এসব বলছি না বাস্তব অবস্থাটা বোঝানোর জন্য আমাকেই এই অপ্রিয় সত্যগুলি উচ্চারণ করতে হচ্ছে। অনুগ্রহ করে এগুলি কারোর নামে কুৎসা বলে ধরে নেবেন না। কিন্তু এরাই সাচ্চা প্রতিষ্ঠান বিরোধী-নিজেদের এতগুলো কাগজ আছে বলে যা খুশি লিখে লোককে বোকা বানাতে পারে। আর আমার সঙ্গে এখানেই এদের তফাৎ। আমার অনেক লিমিটেশান আছে, আছে অনেক স্ববিরোধীতা, মধ্যবিত্তীয় সুবিধাবাদের গ-ি আমি সবসময় কাটিয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু পারতপক্ষে কথায় আর কাজে ফারাক রাখতে অপছন্দ করি। আমার ঘর-দেড় ঘরের একটা ভাড়া করা ফ্ল্যাট-কোনো মধ্যবিত্তীয় ন্যাকামি নেই, সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিল খাট আলমারি কিছুই নেই- ব্যাচেলার অবস্থার খাটের সঙ্গে একটা বেঞ্চি জুড়ে আমাদের তিনজনের শোয়ার ব্যবস্থা। কোনো অতিথি এলে রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা করতে পারি না পর্যন্ত। ঘরটাও প্রতিষ্ঠানবিরোধী-বই শুধু বই- বইটই সরিয়ে লোককে বসতে দিতে হয়। স্ত্রীকে স্বাধীনতা দেওয়া আছে যা খুশি করার- ১০১ ভাগ স্বাধীনতা। সে-ও আমার সংগ্রামের অংশীদার, সে আমার এদিকটা ভালো করেই বোঝে, মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করে। মুখে বড় বড় কথা বলব আর নিজের বউকে হারেমে আটকে রাখব তা হয় না।
পথিক : প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জন্য কি আপনি পাল্টা প্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা করেন। অর্থাৎ কাউন্টার এস্টাবলিশমেন্ট পুঁজির প্রভাবমুক্ত, অবাণিজ্যিক ও পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে একটি পাল্টা প্রতিষ্ঠান কি কাম্য হতে পারে না?
সুবিমল মিশ্র : না, প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার জন্য পাল্টা আর একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি কখনই আদর্শ হতে পারে না। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠানই। তার সমস্ত শ্রেণি চরিত্র নিয়েই তা প্রতিষ্ঠান। পুঁজির প্রভাবমুক্ত, অবাণিজ্যিক ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নির্ভর একটি পাল্টা প্রতিষ্ঠান সোনার পাথর বাটির মত। হয় তা প্রতিষ্ঠান অথবা তা প্রতিষ্ঠান নয়, পাল্টা প্রতিষ্ঠান বলতে কানো কিছুই হয় না। বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিষ্ঠানবিরোধী হবে, আবার পুঁজির প্রভাবযুক্ত হবে-এক সঙ্গে তা কি সম্ভব! ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার একটা প্রতিষ্ঠান সম্ভভ’-অবশ্য প্রথম প্রথম এ কথাটা মনে হলেও হতে পারে কিন্তু আস্তে আস্তে শক্তি সঞ্চয় করলে তা আর বিরোধিতার ভূমিকায় থাকে না, প্রতিষ্ঠিতই হতে চায়-চড়বিৎ-এর ধর্মই প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া। পুঁজির প্রভাবমুক্ত, অবাণিজ্যিক কোনো কিছু এই প্রতিষ্ঠানবিরোধী আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের জটিল পরিস্থিটি আছে, পাঁচের গেরো, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা পাল্টা প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে শক্তি সঞ্চয় করতে করতে একদা প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে দেয়, ধীরে ধীরে আস্তে আস্তে আমাদের অলক্ষ্যেই সে একটা প্রতিষ্ঠিত শক্তিরূপে নিজেকে বিস্তার করে নেয়, প্রথমে আমরা সহজে টের পাই না, যখন টের পাই তখন খুব একটা কিছু করার থাকে না, তখন তথাকথিত অপ্রাতিষ্ঠানিকতার দু’দিকের চোয়ালে বিষদাঁত গজিয়ে গেছে, প্রতিষ্ঠানের মত সেও ছোবল মারতে থাকে। লেজ আছড়াতে থাকে তুমুলভাবে। সামান্য বিরোধিতাও সে আর সহ্য করতে পারে না। হ্যাঁ চেষ্টা করে দাঁত দুটো হয়তো ভেঙ্গে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু যেহেতু তা প্রতিষ্ঠান, মানে প্রতিষ্ঠান-রূপ ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেছে-কিছুদিন বাদে তা আবার গজাবে, আবার বিষ-ভরপুর হবে, হবেই।
তাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাকে নিরন্তর গতিতত্ত্বে আমি অন্বিত করতে চাই, নিরন্তর পথ চলা, নিরন্তর নিজেকে পাল্টে পাল্টে, নিজের উপর চোখ রেখে যেন কোথাও কোনো বদ্ধজলায় আটকে যাওয়ায় নিজেকে প্রশ্রয় না দিই, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাকে অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন কখনো যেন না দেখার সাধ জাগে।
এসব নিয়ে আরো অনেক গাণিতিক দার্শনিক কচকচি, হিসেব নিকেশ আছে, হয়; সাক্ষাৎকারে তার অবতারণা অবান্তর। আমার অন্যতর আলোচনাগুলি, বিশেষত: ‘পাতাল গাড্ডি’ জাতীয় নিবন্ধগুলি দেখে নিলেই ভালো হয়।
......................................................................................
প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার মূল দিক : সক্রিয়তা, সংগ্রাম
সংগ্রামই লেখকের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। ঋত্বিককুমার ঘটক আপনাদের কথার উত্তর খুব সুন্দরভাবে দিয়েছেন আমার শিল্পীজীবনের সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় এই দুই অবস্থাতেই বুঝেছি যে সংগ্রামকে শিল্পীজীবনের নিত্যসঙ্গী করে তুলতে হয়। নানা প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কাজ করে যেতে হবে। সাময়িকভাবে কোনো সঙ্কট আচ্ছন্ন করে ফেললেও সামগ্রিকভাবে তা যেন আপোষের পথে টেনে না নিয়ে যায় অর্থাৎ সঙ্কটের কাছে যেন আমরা বিবেক-বুদ্ধি সব কিছু নিয়ে আত্মসমর্পণ না করি।
পথিক : মনে করেন প্রকৃতপক্ষেই লিটল ম্যাগাজিনের স্রোত বা সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানবিরোধী একটা স্থান থেকে আপনাকে পুরস্কার দেয়ার চিন্তা করল-আপনি কি করবেন?
সুবিমল মিশ্র : পুরস্কার সবসময় এক গোদা প্রাতিষ্ঠানিক পথ, তা সে যেখান থেকেই আসুক না কেন। একজন সক্রিয় মানুষকে থামিয়ে দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়াই যার প্রধান কাজ-যা আমি মনে প্রাণে ঘৃণা করি। একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধীর পেছনে পুরস্কার নেড়ি কুত্তার মতো ঘোরে, তাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে চায় আর সে তাকে ঘোরায়, ঘোরায় চরকির মত, ঘোরাতে থাকে, প্রতিষ্ঠানেরই মাথা ঘুরিয়ে দেয়- সোজা কথা নিরন্তর পাত্তা না দিতে থাকে। আবার হয়তো, হয়তো কেন ঠিকই, ঠিক-ঘরাণার মানুষের অগ্নি পরীক্ষা হয়ে যায় এই পুরস্কার নেওয়া না নেওয়ার মধ্য দিয়েই। আবার পুরস্কার না নিলেই সে মহৎ লেখক, এমনটা নাও হতে পারে...
পথিক : বর্তমানে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’-এ নিয়েও প্রাতিষ্ঠানিক কাজ চলছে। ব্যবসা করছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা মোড়ে মোড়ে নিজেকে বিপন্ন করাতো দূরের কথা তার ধারে কাছেও নেই- এ মুহূর্তে নিজের বিরুদ্ধে নিজেকেই সতর্ক থাকতে হয়-এসব প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধীদের কি করা উচিৎ?
সুবিমল মিশ্র : নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে লাগিয়ে রাখা, নিজের যুক্তিগুলোকে সর্বদা চ্যালেঞ্জ করা, চ্যালেঞ্জ করতে থাকা আদৎ কথা,-আর তারপরেও কথা আছে... অনেক কথা আছে...
..................................................................................................................................................
এতদিন ধরে লিখছি ভুল
করিনি এটা তো হতে পারে না।
আমিও তো মানুষ। ভুল অনেক
করেছি আর করি। তবে যখন সেটা
বুঝতে পারি, তা সরাসরি স্বীকার
করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।
কিন্তু মজার কথা কোনটা
ঠিক আর কোনটা ভুল সব সময়
সেটা বোঝা যায় না। আবার
ভুল বা ঠিক বলে কিছু আছে
কিনা সে সম্বন্ধেও আমার সন্দেহ আছে।
..................................................................................................................................................
পথিক : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বিষয়টির শেষ কি আপনি আঁকতে পারেন?
পথিক : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বিষয়টির শেষ কি আপনি আঁকতে পারেন?
সুবিমল মিশ্র : না পারি না, আগামী শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠান যে রূপ নেবে তার উপর তার বিরোধিতা নির্ভর করবে। ইতিমধ্যেই মিডিয়ার দৈত্যাকার বিস্ফোরণ ঘটেছে, আজ সর্বব্যাপি, আমাদের অন্দর মহলেও সে ঢুকে পড়েছে, ঢুকে পড়েছে একেবারে নির্বিবাদে-দশ-পনের বছর আগে যা কল্পনা করা যেত না। এসব বাস্তব ঘটনা, এসব কিছু মনে রেখেই কিন্তু কাজ করে যেতে হবে, আপন লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে। তবে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার যে চিরন্তন দিকটি রয়েছে-সব কিছুকে এক ছাঁচে ফেলে মানিয়ে নেবার বিপরীতে যার যাত্রা,-সে সুদূর সক্রেটিস বা তারোও আগে থেকে যার অস্পষ্ট সূচনা হয়েছিল-তা যতদিন মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন থাকবেই। একজন অন্তত চিৎকার করে বলতে পারবে- মানি না তোমার ঐ ‘ছকবাঁধা’ চিন্তা পদ্ধতি, তোমরা যা ধরে নিয়েছো তাকে আবারও পরীক্ষা করতে দাও, তোমরা যা শেখাবে, বলে দেবে, সেটাই শেষ কথা নয়,-মানুষের, চিন্তাঋদ্ধ একটি সমাজের শেষ কথা বলে কিছু থাকতে পারে না। চিরন্তন সত্য বলে কিছু নেই সত্য সবসময়ই আপেক্ষিক, স্থান কাল নির্ভর। আবার আমার এই কথাটাও শেষ কথা নয়, এক স্থান-কালনির্ভর আপেক্ষিক এক সত্য নির্ধারণের চেষ্টা মাত্র।
[এই সাক্ষাৎকারটির উত্তরগুলো খুব-খুবই দ্রুত করা, অনুগ্রহ করে এগুলো আমার কথা, হুবহু আমার লিখিত বক্তব্য বলে ধরে না নিতে বিশেষভাবেই অনুরোধ করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক অবান্তর কথা বলা হয়ে গেছে, যা বলতে চেয়েছি উল্টোটাও ঘটে গেছে কোথাও কোথাও, কিছু ক্ষেত্রে ঠিকমতো গুছিয়ে বলতে পারিনি, অসম্পূর্ণতাও থেকে গেল- বেশ বুঝতে পারছি। পথিক অনেকদিন আগেই প্রশ্নগুলো দিয়েছিলেন, দু-দুবার এসে ফিরে গেছেন, আমি কিছুই করতে পারিনি। তাঁর কাছে আমার ঋণের শেষ নেই, কেন যে তিনি আমার মত একজন অ-লেখকের ওপর সংখ্যা করতে গেলেন তাই তিনিই জানেন। আগের দিন রাত্রে আমার স্ত্রী প্রশ্নগুলো পড়ে যায় আর আমি টেপ-রেকর্ডার মুখে মুখেই এই উত্তরগুলো করে দেবার চেষ্টা করি। এত দ্রুত, এভাবে আমি কখনো কোনো সাক্ষাৎকার দিইনি। টেপরেকর্ডার থেকে কল্পনা নিজের হাতে লিখে নিয়েছে, সে-এক অমানুষী পরিশ্রম-এতটা দ্রুততা ছিল যে চোখ বোলাবার সময় পর্যন্ত পাইনি। প্রশ্নগুলো, আরো অনেক কিছু প্রশ্ন, যে গুলো বাকি থেকে গেল একসময়ে ধীরে সুস্থে আমি লিখিতভাবে করে দেবো একথা দেওয়া থাকল।
পাঠক মহোদয় যদি অনুগ্রহ করে আমার এসব, এভাবে উত্তর দেওয়ার ধৃষ্টতা, মার্জনা করে নেন, বাধিত হবো।]