সোলেমানের বমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে জজের কালো কোটে - কামরুল হুদা পথিক

কামরুল হুদা পথিক

সম্পাদক: দ্রষ্টব্য ও করাতকল

সর্বশেষ

Home Top Ad

আপনি জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামের বুনোশুয়োর আপনাকে থাকতে দেবেনা কারণ, তাদের ‘ঘি’ বলেন আর ‘গু’ বলেন কোন কিছুতে ‘না’ নেই

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯

সোলেমানের বমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে জজের কালো কোটে

দৃশ্যটা বীভৎস এবং বিকৃত। মানুষ তার দিনযাপনকালে অনেক দৃশ্য-ঘটনাই অতিক্রম করে, যার অনেকগুলোই দ্রষ্টাকে কিছুক্ষণ তাড়িত করে এবং অতঃপর দৃশ্যান্তর হয়। আবার অনেক দৃশ্য ঘটনা দ্রষ্টাকে কিছুক্ষণ তাড়িত করে, দৃশ্যান্তর হয়-আবার পুনরায় ফিরে আসে-পুনরায় তাড়িত করে। ঠিক এ রকমই একটা দৃশ্য এই গল্পের মূল ¯্রােতে প্রবাহমান, যা একাধারে বীভৎস এবং বিকৃত, একবার চোখে পড়লে দ্রষ্টা সেখান থেকে সরে আসতে পারে না। অনেক সময় দ্রষ্টা নিজে সরে আসার চেষ্টা করলেও দৃশ্যটাই দ্রষ্টার পিছু নেয়, তাড়া করে। ঠিক সে রকমই একটা দৃশ্য সোলেমানের সাথে ঘুরে বেড়ায়, খাবার পাত ভরে থাকে, ভিটিতে গাঢ় ছায়ার মত শুয়ে থাকে, রাতে তার বিছানার পাশে কিংবা কেরোশিনের কুপির ছায়ায় বিশ্বস্ত বিড়ালের মতো শুয়ে থাকে।

সোলেমান ওয়াক্ করে বমি করল। এ মাত্র যা খেল, পুঁইয়ের ঝোল-তরকারি আর পুঁটি মাছের চচ্চড়ি। দু’তিনবার ওয়াক্ করতেই ছোটো চৌকির সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আধ-পরিপাক ভাত-তরকারি। সোলেমানের শরীরটা ক’মিনিট চিকন ঘাম দিয়ে জুড়িয়ে যায়। চোখ লাল। অনির্দিষ্ট দৃষ্টি। সোলেমানের বউ রাহেলা কি করবে ভেবে পায় না। চিন্তিত হয়। সংসার অনড় ও বিস্ময় প্রকরণে ঝিমুতে থাকে। 

সোলেমান নিজেও নৈর্ব্যক্তিক। ভাষা আছে কণ্ঠে এবং দৃষ্টিতে, কিন্তু বোঝানো যাচ্ছে না বা বোঝাতে পারছে না। দৃশ্যটাকে কি বলবে? স্বচক্ষে দেখা দৃশ্যটা দেখার পর থেকে সম্পূর্ণ স্তব্ধতায় নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছে। বোঝা যায়, বোঝানো যায় না। শুধু এটুকু মনে থাকে যে, দৃশ্যটা বীভৎস এবং বিকৃত। সোলেমান খাবার প্লেটে যা দেখে, তা যেন ঐ বীভৎসতাই চেটেপুটে খাওয়া, ঘুমোতে গেলে দু’চোখ বন্ধ করা মানেই একটা বীভৎস অন্ধকারের আদলে দৃশ্যটা কালো পর্দামত প্রিন্ট হয়ে থাকে। 
দৃশ্যটা সোলেমান কতক্ষণ দেখেছিল মনে নেই। তবে অনেকক্ষণ দেখেছিল কিংবা নিজের অজ্ঞাতেই দাঁড়িয়েছিল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দৃশ্যটা চোখে পড়ার পর তার শরীরের উপর যেন একটা বিদ্যুৎ-থাবা লাফিয়ে পড়ে এবং একটা ভারি পাথর তার সমস্ত বোধের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেলে সোলেমান বিদ্যুৎ-পিষ্ট মৃতবৎ অর্থহীন ফ্যালফ্যাল তাঁকিয়ে থাকে। যখন মনে এসেছিল, তার সামনে আস্ত মেয়েটার বিবস্ত্র, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, উলঙ্গ ও রক্তাক্ত দেহটা অনেকগুলো পাটগাছ ভেঙ্গে-চুরে মৃত ও অসাঢ় পড়ে আছে তখন থেকেই দৃশ্যটা নৈর্ব্যক্তিক, বীভৎস, বিকৃত এবং সোলেমানকে তাড়া করছে। 

রাহেলা বমির উপর চুলো থেকে ছাই তুলে ছড়িয়ে দেয়। দৃশ্যটার উপর যেন একটা ছাইরঙা চাদর জড়িয়ে দেয়া হলো সোলেমানের চোখের সামনে। কেউ এটা সরিয়ে রাখছে না, এর সৎকার কিংবা সুরাহা করছে না। দৃশ্যটা সোলেমান থেকে ঘর- গেরস্থালি অতঃপর তরলায়িত হয়ে ক্রমশ চারদিক ছড়িয়ে পড়েছে। সোলেমান জানে না এ দৃশ্যটা নতুন নয়, পুরাতন, এ দৃশ্য দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এবং ছিলোও। জানার কথাও নয়, এরা এ দেশের ৭৪ শতাংশ লোকের দলভূক্ত, যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই। এদের খবরের কাগজ পড়ার ক্ষমতা নেই, এদেও পয়ঃপ্রণালী সু-ব্যবস্থা নেই, এদের পুষ্টি নেই, এদের নিজের কোনো চাওয়া নেই, চাইতে নেই। কিন্তু এদের নিয়ে প্রতিবাদের মিছিল সাজানো হয়, এদেরকে মিছিলের সম্মুখে এগিয়ে দেয়া হয়, জাতিসংঘে কথা বলা হয়, এদেরকে ইস্তেহারের উপাদেয় বিষয় করে তোলা হয়। অথচ এদেরকে বাদ দিয়েই উপরঅলারা পরিকল্পনা করে, রাজনীতি করে। এদের দাবী মেটাতে হবে, এরা হচ্ছে উপাত্ত, উপাত্ত হচ্ছে নিরীক্ষার উপকরণ। তা সবসময় বাস্তবায়ন হতে হবে, সেরকম কোনো কথা থাকে না, কথা নেই। এরা নিগৃহীত এবং নির্যাতিত কিন্তু রাজনীতিকদের উপজীব্য বেশ মজাদার এবং উপাদেয়। এদের দেশ-কাল নিয়ে কিছু ভাববার নেই, ভাবতে হয় না, ভাবতে দেয়া হয় না। গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার নামে একটা এনজিও দৈনিক পত্রিকাগুলোর তথ্যভিত্তিক গত দু’মাসে দেশের যে চিত্র দিয়েছে সেখানে আহত হয়েছে ৩,০৩২, খুন হয়েছে ৩৬৩, ধর্ষিত হয়েছে ৭৮৪, গুম হয়েছে ৪৬ জন। যে কোনো স্থানে এ ধর্ষণের চিত্র বীভৎস, বয়স ১৪-২৪। পড়–য়ারা মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের। যারা স্কুলে যায় না কিংবা যেতে পারে না তারা বুঝতে পারে কৈশোরীয় স্তর পার হয়েছে কিংবা হোচ্ছে। হয়ত কাওকে কোনো রাস্তার মাঝ থেকে তুলে আনা হয়েছে কিংবা সিঁধ কেটে মুখে কাপড় গুঁজে বের করা হয়েছে কিংবা ছল-চাতুরী করে ফাঁদ থেকে তুলে আনা হয়েছে, পাঁজাকোলা করে কোনো জমির খোলা বুকে, ফসলী জমির মাঝ-উঁচু-আইলে, গ্রাম-মাঠ পার হয়ে হয়ত কোনো জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে...শাপদসংকুল, নির্জন ও স্তব্ধতা। হাত পিছমোড়া বেঁধে কিংবা সারা শরীর গাছের সাথে বেঁধে বিকৃত কামবোধ, চিরে-ছিলে মনুষ্য বৈশিষ্ট্যলোপ, পশুবৃত্তি, অসভ্যতার ভেতর অসভ্যতা, মানুষের ভেতর অমানুষিকতা, এক ধরনের কুরুচিপূর্ণ আনন্দে মাতাল হওয়া। চোখের সামনে জলজ্যান্ত এ দেশের নারীদের উলঙ্গ করা হয়েছে, ধর্ষণ করা হয়েছে, তারপর মাথার ভেতর থেকে যখন হিং¯্র পোকাটা নেমে যায় তখন পুলিশের ভয়, জবানবন্দী, জেল, ফাঁসির চিন্তা। তাই আদিম প্রবৃত্তিতে খুন, লাশ গুম্, পুঁতে ফেলা, বস্তায় ভরে ইট বেধে নদীতে-ডোবায় ফেলে দেয়া, অতঃপর নিজেরা নিরাপদ স্থানে সরে যায়, নিজেরাই গুম হয়ে যায়, উপরঅলাদের ছত্র-ছায়ায় মিশে যায়।



Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages