মাটি পুড়ে পুড়ে শিল্প হয়ে যায়
আর শিল্প পুড়ে পুড়ে মাটি হয়ে যায়...
আগুনের উপর দিয়ে অবলীলায় হেঁটে যায় আগুনমুখা পাখিরা। মাতৃগর্ভের ভ্রƒণেই বুঝি খুব সযতনে বুনে দেয়া হয়েছিলো কোনো আগুনের বীজÑএই বীজপত্রের ভাঁজে পার্থিব আমাদের অনেকেরই বয়ে বেড়ানো বীজঘুম। বীজপত্র থেকেই বিস্ফারিত আগুনমুখা পাখিদের ক্রোধের শাখা-প্রশাখা, মানুষ, মূল্যবোধ আর চিন্তা জগতের ভিন্নতা, দৃষ্টিচক্ষুর ও সৃষ্টিশীল উন্মাদনার ভিন্নতা, ভিন্নতা সৃষ্টির সুধারস গ্রহণ-বর্জন প্রক্রিয়ার। তাই এই পৃথিবী নামক ক্ষুদ্র গ্রহের ভূগোলে যে সংগ্রামের নৃ-ইতিহাস টেরাকোটায় দৃশ্যমান-তার পাশেই সমান্তরাল বয়ে চলে সুরা-সাকি-বাঈজী-বাজার-পুঁজিÑবন্দুকবৃত্তিক বিলাস-উল্লাসের বীর্য-ঘুমের সার্কাস। কিন্তু সর্বকালেই ছিলো এসকল আগুনমুখা পাখিরা, যারা মাটি পুড়ে পুড়ে শিল্প বানিয়েছে, আবার শিল্প পুড়ে পুড়ে মাটি বানিয়েছে, কারণ আগুন ও মাটিই প্রথম ও শেষ কথা।
পুঁজি গিলে খায়, চেটে খায়, শুষে খায় নিজ বীর্যপুঁজ
আমি ধ্যানী ঋজুতায় ন্যুয়ে থাকি আমার সৃষ্টির পদমূলে...
বৈশি^ক পাগলামীর খ্যামটা নৃত্যে উন্মাদ পুঁজির মোড়ল। ঊর্ধ-অধ:, ডান-বাম কিংবা আগে-পিছে পুঁজির উন্মাদনায় বেদখল হয়ে যাচ্ছে আমাদের আকাশ-বাতাস-সমুদ্র-নদী-প্রকৃতি-মানুষ। লাঙল যার জমি তার এ তত্ত্ব বদলে গেছে নয়া সূত্রে পুঁজি যার জমি তার। পুঁজি বহরের মাতাল নৃত্যে কিংবা পুঁজি বৃষ্টির কলকব্জায় কিংবা যুদ্ধ বিমানের ভূ-কম্পিত বীভৎস শব্দ গহ্বরে নৃ-সভ্যতার পোশাক খুলে পড়া বিকৃত যৌন উৎসবে আত্মবীর্য চেটে খাওয়া নয়া সভ্যতার ভিতর ক্রমশ জন্ম নিতে থাকে আগুনমুখা পাখির ছাই থেকে নতুন ফিনিক্সের দল। আর নিজের সৃষ্টির পদমূলে ন্যুয়ে থাকে ঋজুতায় আগুনের সব পাখি।
আমাদের লালনও চাই, মফিজও চাই
যা, খেলারাম খেলে যা...
যেন সওদাগরের বজরায় আলু-ডাল-পটলের সাথে তুলে দেয়া হয়েছে, হচ্ছে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। টালমাটাল বণিকী চরিত্র আমাদের রাষ্ট্রকে গিলে খাচ্ছে আর রাষ্ট্র গিলে খাচ্ছে আমাদের মানবিক চৈতন্যকে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জোয়ার যেন শিল্প বর্জে সয়লাব কোনো পুরোনো মিঠা পানির নদী। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার মাঝেই অন্ধকার ছেয়ে থাকে, বাংলা একাডেমির ফটক নির্মাণের নিজ ক্ষমতা বিসর্জন দিয়ে সেখানে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে বাজারি লকেট। মৌলবাদি জঙ্গীপনার অগ্রসরতার পাশে নির্জীব ও অসহায় শুয়ে থাকে শক্তিমান রাষ্ট্রীয় নির্বিষ ঢোঁড়া সাপ। লেখকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হরণকারী ঘোষণাপত্র পাঠ করে মহান বাংলা একাডেমির মোড়ল। আর আগুনের পাখিরা যন্ত্রণায় পাখা ঝাপটায় প্রত্যক্ষ করে এক মহাবাজার, শ্রেণিবৈষম্যের ধুম্রজাল, রক্তখেকো জঙ্গীপনা। পরিত্রানের উপায় খুঁজে শুরু করে আবার আগুনমুখা যাত্রা। আগুনে ঝাঁপ দিয়ে যেন গাইবে বিনাশের গান।
নিজেকে শূন্য করে ফেলি
তারপরও কোনো গুরুকে রাখি না আমলে...
দ্রষ্টব্য’র বিরতী যেনো এমত এক বীজঘুমই। আগুনের ওমে উত্তাপিত হওয়ার বুঝি প্রয়োজন ছিলো দানা বাঁধার। পুঁজি নৃত্যের দম্ভে উড্ডীয়মান লিঙ্গ ব্যবস্থাপনায়, ঢোলবাদ্যি-কর্তালের দানবীয় চিৎকার বুঝি প্রয়োজন ছিলো জেগে ওঠার। বীজঘুম থেকেই বিস্ফারিত চিৎকারে জেগে ওঠে দ্রষ্টব্য’র অগ্নি উত্তাপিত পাটাতনে আগুনমুখা পাখিরা। ‘স্যানেটোরিয়াম’ এক অসমান্য উপন্যাসের জনক মাত্র চার দশকের জীবন, যার, নূর হোসেন কে স্যালুট জানিয়ে ২০১২তে যে দ্রষ্টব্য-১১ এর প্রকাশ, ২০১৬তে দ্রষ্টব্য-১২তে গ্রোথিত হয়েছে একই সুর, একই ধমণী, একই রক্তকণিকা, সেই একই সৃষ্টিশীলতার উন্মাদনা।
আগুনমুখা পাখিদের যাত্রা-সঙ্গ থেকে এবারো বেরিয়ে পড়েছে কেউ কেউ, মর্মবেদনা রাখি না, রাখতে নেই বরং ওঁম্ শান্তি বলে সম্মুখে অগ্রসর পথে সহযোদ্ধাদের জন্য দরজা খুলে দেই। দ্রষ্টব্য সূচিতে প্রথমবারের মতো সূচিবদ্ধ হয়েছে লিটলম্যাগাজিনের সাত গল্পকারের সাত গল্প নিয়ে শিল্পী চারু পিন্টু’র গল্পচিত্র, পান্ডুলিপি সংস্করণে কবি বিপ্লব বিপ্রদাসের কাব্যগ্রন্থ ‘বিষাক্ত পাতার কোরাস’ আর কবি শাফি সমুদ্র’র গল্পগ্রন্থ ‘একটি প্রস্তাবিত মৃত্যু ও একজন ঈশ্বরের প্রতিপক্ষ’, পুণর্পাঠে পুণরায় পড়তে সূচিবদ্ধ হয়েছে সৈয়দ রিয়াজুর রশীদের গল্পসহ একটি সাক্ষাৎকার। জিয়াউদ্দিন শিহাব সহ ৫ গল্পকারের আর লুৎফুন নাহার বুলবুল ও সা’ইফ সজল সহ ১২ কবির কবিতা, ‘আগ্রাসনের বিপরীত প্রকল্প’ দ্রোহের চিত্রকলা নিয়ে চিত্রশিল্পী উমা মন্ডল’র অন্তর্ভূক্তি ছাড়াও দেশ ও শহরের ভিন্নমাত্রার সংশ্লেষণ কেলাশনে গদ্যশিল্পী ঋষি এস্তেবান-এর উপন্যাস ‘যে মানুষটি তার দেশ খুঁজে পায়নি’ আর কামরুল হুদা পথিক-এর মাতাল শহরের গল্প কবিতা পঁচিশটি এ চিত্রায়িত শহরের অবক্ষয় পাঠযোগ্য হতে পারে। এবার ইচ্ছে করলে দ্রষ্টব্য’র পাতা উল্টাতে পারেন... শুরু করতে পারেন...‘ওঁম্ শান্তি ওঁম্...’
দ্রষ্টব্য কোনো নির্দিষ্ট ভূগোলের কাগজ নয়, দ্রষ্টব্য কোনো বিশেষ নৃ-গোষ্ঠির কাগজ নয়, দ্রষ্টব্য বাঙলা ভাষার ছোটকাগজ। দ্রষ্টব্য নিজেকে বাতিল করার সকল প্রকার মোহমুক্ত, দ্রোহ ও একটি আক্রমণের কাগজ।