দ্রষ্টব্য, করাতকল এবং একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সম্পাদক কামরুল হুদা পথিক - কামরুল হুদা পথিক

কামরুল হুদা পথিক

সম্পাদক: দ্রষ্টব্য ও করাতকল

সর্বশেষ

Home Top Ad

আপনি জীবদ্দশায় অপ্রাতিষ্ঠানিক থাকতে পারেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠান নামের বুনোশুয়োর আপনাকে থাকতে দেবেনা কারণ, তাদের ‘ঘি’ বলেন আর ‘গু’ বলেন কোন কিছুতে ‘না’ নেই

বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৯

দ্রষ্টব্য, করাতকল এবং একজন প্রতিষ্ঠানবিরোধী সম্পাদক কামরুল হুদা পথিক

দ্রষ্টব্য ১২ নিয়ে কাজের সুবাধেই শ্যামলী শাফি সমুদ্রদের বাসায় ক’রাত থাকা। কবি শাফি সমুদ্র, কথা শিল্পী ঋষি এস্তেবান, শিল্পী চারু পিন্টু থাকেন সেই বিখ্যাত বাসায়। মহান ঋষির রান্না করার অভিজ্ঞতা আর সেবা প্রদানের ইচ্ছা থেকে খাওয়া পর্ব সারা, ব্যাক্তিগত ফোন-এফবি ফিরিস্তি আর চরম আড্ডা। বহুদিন পর আমি শিল্পমগ্ন ছিলাম। আড্ডার বিষয় আসয়ে মূলত আমাদের লেখা-লেখি, অন্যান্যদের অবস্থান, পূঁজি-পণ্য-বিজ্ঞাপন, লিটল-বিটল-মিডল বাজারী ছোটোকাগজের ভিড় আর আমাদের ভবিষ্যৎ লড়ে যাওয়ার চিন্তা উঠে আসে প্রতিদিন। ১০ ফেব্রুয়ারির রাত তখন পরদিনে চলে গেলেও আড্ডা চলছিলো আর সে আড্ডাটি রেকর্ড করা হয়েছিলো। সে আড্ডার আলোচনা দিয়েই করাতকল ০৩ এ শুরু হোলো করাতকল আড্ডার নিয়মিত অধ্যায়।     
                                                                                          


শাফি সমুদ্রঃ দ্রষ্টব্য ১২, এবার তিন বছর পর বের হচ্ছে। আপনার কেমন লাগছে?

কামরুল হুদা পথিকঃ দ্রষ্টব্য বের হওয়ার পেছনে কখনও সুখকর অভিজ্ঞতা নেই, সে সব আলোচনা কোনোদিন উঠে আসবে হয়তো। কারণ দ্রষ্টব্য কোনো মসৃণ সাহিত্যের কাগজ নয় বরং গত ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর সময়ে দ্রষ্টব্য ১২ বের হচ্ছে, যা পুনরায় নিশ্চিত হলো দ্রষ্টব্য তার লড়াকু জায়গায় আছে। যেদিন আজকের ভার্চুয়াল প্রচ্ছদটি হাতে নিয়ে দেখবো সেদিনতো অনেক ভালো লাগা থাকবেই।

শাফিঃ করাতকল এ সময় বাঙলা ভাষার সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ছোটোকাগজ। প্রশ্ন হচ্ছে আপনি দ্রষ্টব্য নামে যে কাগজটি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে করে আসছেন এবং আগামিতেও করবেন, সেখানে করাতকল নামে আরেকটি কাগজ করাকে জরুরী মনে করলেন কেনো?

কাহুপঃ না, করাতকল করাকে কখনোই জরুরী মনে করিনি। আর এক অর্থে কোনো কিছুই জরুরী নয়। তবে কথাটা এভাবে বলা ভালো, দ্রষ্টব্য ছোটোকাগজটি এবং তাকে ঘিরে যে দীর্ঘ পথ পরিক্রমা যে পথে একটা দ্রোহের বীজ বপন, অঙ্কুরোদগম এবং তার শাখা প্রশাখার বিস্তার তার ভেতরেই করাতকলের জন্মসূত্রটি গ্রোথিত এবং আমি মনেকরি যারা দ্রষ্টব্য পড়েছে বা এখনো পড়ে তারা এটা টের পায় নিজেকে বিপন্ন করে এক ধরনের মায়াঘোরে আমি ক্রমশ আবদ্ধ হয়ে পড়ছি। গতো ৩/৪ বছর ধরে আমার থট প্রোসেসের মধ্যে নিজেকে এক ধরনের বাতিল করণের একটা অণুরণন টের পাই। আর তখন আমি একটা কবিতা লিখি, যে কবিতাটি আমার মাতাল শহরের গল্পগ্রন্থে যাচ্ছে, <করাতকল ও কটা চোখওয়ালা> শিরোনামে। যেখানে আমি নিজেকে একটি করাতকলের পাটাতনে শুয়ে রেখে অপেক্ষা করছি কখন একটা কটা চোখঅলা মায়াবী নারীর হাতে বটম টিপে দেয়ার পর আমার দেহ চেরাই হয়ে যাবে আর আমি আমার চেরাই হওয়া দেহের বিচ্ছুরিত লহুদৃশ্য দেখার জন্য উদগ্রীব। সেখান থেকেই মূলত করাতকল নামটি আমার হয়ে পড়ে। চিন্তায় আসে দ্রষ্টব্য প্রকাশনার জায়গাটি হোক করতাকল আর করাতকল নামেই ৩২ পৃষ্ঠার একটা টোটাল টেক্সট-এর কাগজ আসুক কনসেনট্রেটেড ভার্সন রূপে। সেখান থেকেই আজ করাতকল ০৩ বেরিয়ে আসছে।

শাফিঃ কিন্তু আপনার এই যে চিন্তা, তা কি দ্রষ্টব্যের মাঝে ছিলো না বা এখন নেই? যদি থাকে টা হলে করাতকল কেনো?

কাহুপঃ  হ্যাঁ, এটা খুব মজার একটা প্রশ্ন। দ্রষ্টব্য তো শুধু আমার কাগজ নয়। দ্রষ্টব্য আপনারাই করেন তাই ওখানে কি আছে বা কি লিখি আমরা তাতো পাঠক মাত্রই জানেন। আমার মনে হচ্ছিলো দ্রষ্টব্য বের করতে করতে-বর্তমানে বাজারী বা ক্যাপিট্যাল ব্যাবস্থাপনায় যে ধরনের প্রচলিত এবং পপুলার লেখাজোকা চলছে তার ঠিক বাইরে বা বিপরীতে বললে ভালো হয়, পুঁজিবাদি সমাজ ব্যাবস্থায় বা বুর্জোয়া-পেটি বুর্জোয়া কাঠামোকে সরাসরি আক্রমণে করতে পারে-এ রকম একটা লেখা পাঠককে বুঝে উঠতে গেলে বহুক্ষণ তাকে কিছু পাঠ করতে হয়। কিন্তু আমি ভাবলাম করাতকল থেকে আমাদের গ্রন্থসমূহ বের হওয়ার সাথে সাথে করাতকল নিজেই একটা কাগজ হোক-যার আয়তন ২ ফর্মা ( ৩২ পৃষ্ঠা ), যার মধ্যে নাতিদীর্ঘ কোনো লেখা, যা নাকি আবার অনেকটা ভিজ্যুয়ালাইজও-প্রকাশিত হোক, যা পড়ে পাঠকের বোধে সহজেই আসা সক্ষম পুঁজিবাদী আগ্রাসনের নেতিবাচক দিক আর বাজারী শিল্প সাহিত্যের উপর কি ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে লেখাগুলো। করাতকল যেনো পাঠকের হাতে দ্রষ্টব্য’র একটা কনসেনট্রেড মিনি ভার্সন। আসলে সেখান থেকেই আমার দ্রষ্টব্যের পাশাপাশি করাতকল এর চিন্তার সূত্রপাত, যা ২০১৩ তে ১ম সংখ্যার জন্ম।

শাফিঃ আক্রমণটা আসলে কাকে? কে শত্রু?

কাহুপঃ আক্রমণটা আসলে সামাজিক অসঙ্গতিগুলোকে। ওদেরতো আর হাত পা নেই, তাই এসকল অর্ধ-মনষ্ক ব্যাবস্থাপনাগুলো ভর করে থাকে আমাদের ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাপনায়, আমাদের ইকোনোমির উপর, আমাদের স্যোশাল স্ট্রাকচারের উপর, আমাদের ইদোকেশন আর আমাদের লেখালেখির উপর। তাই শেষ পর্যন্ত এগুলোর এক ধরনের প্রাণীয় বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। তো আক্রমণটা সবগুলো আশ্রয়দাতাদের উপরই প্রতি বলা যায়। এখন আপনারো কিন্তু আক্রমণের মাধ্যম ভাষা। এখন আপনার মাধ্যম যদি হয় উপন্যাস তখন তা দিয়েই আক্রমণ করতে হবে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লালসালু সে সময় খুবই সাহসী আক্রমণ ছিলো। আপনার মাধ্যম কবিতা হতে পারে, পেইন্টিংস হতে পারে, গল্প হতে পারে। আমার এক্ষেত্রে কথা হচ্ছে তা চলবে, চলুক কিন্তু আমাদের সে কথাগুলো যদি ২পাতার একটা টেক্সটে ধরিয়ে দিতে পারি, টা হলে বিষয়টা বেশ মজার। আপনাকে যখন আপনার লেখাই পণ্য হয়ে যায় তখন আপনি নিজেও হয়ে পড়েন এদেরই সেবাদাসে। তাই প্রথম আক্রমণ এই সকল বাজারী লেখা ও লেখকদের। এ ক্ষেত্রেই করাতকলের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। যেখানে আপনি ভন্ডামীর মুখোশ খুলে ফেলতে পারে আপনার ধারালো ও ভিজ্যুয়ালাজেশনের ক্ষমতার বলে।

শাফিঃ আচ্ছা পথিক’দা, আপনি একই প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে দ্রষ্টব্য ও করাতকল করছেন। কেনো? আর দুটোর মধ্যে যোগসূত্রই বা কোথায় আবার ব্যাবধানই বা কোথায়?

কাহুপঃ দ্রষ্টব্য একটি লিটলম্যাগাজিন, একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যের কাগজ। আমরা যারা দ্রষ্টব্যে লিখি সে লেখা বা লেখক দু’জনের অবস্থানই কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এখন আমরা যারা দ্রষ্টব্যে লিখি সে লেখা বা লেখক কিন্তু যে কেউ নয়। তারা স্পেসিফিক। ধরুন দ্রষ্টব্য ১২ তে আমরা ঋষি এস্তেবান কিংবা অনেকদিন পর জিয়াউদ্দীন শিহাবের যে গল্পগুলো ছেপেছি তা কিন্তু কোনোভাবেই প্রথাগত কোনো লেখা নয়। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জায়গা থেকে লিখি।

শাফিঃ দ্রষ্টব্য একটি লিটল সাহিত্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিন?

কাহুপঃ অভ্যিয়াসলি। দ্রষ্টব্যকে আমাদের গবেষণার জায়গা বলতে পারেন। দ্রষ্টব্য যারা পড়ে তারা বোঝে দ্রষ্টব্য সম্পাদনার মাধ্যমে একদল লেখক ও পাঠক তৈরি হচ্ছে এবং হতে থাকবে যারা সামাজিক অসঙ্গতি, বুর্জোয়া ও প্রচলিত সাহিত্যের সরল পথকে উপেক্ষা করেই। বলতে পারেন ফ্ল্যাট বা ল্যাবরা মার্কা তথাকথিত জনপ্রিয় ল্যাঙ্গুয়েজ বা ভাষা বা বাজার চলতি ধারার বাইরের একটি কাগজ। করাতকল সেরকমই। তার মানে ইডিওলজিক্যালী এই দু’য়ের মধ্যেতো কোনো পার্থক্য থাকতেই পারে না বরং কিছুটা পার্থক্য যদি বলতে হয় তা হচ্ছে আক্রমণের দিক দিয়ে। দ্রষ্টব্যের আক্রমণ যদি কোনো পরোক্ষতা থাকে করাতকলের ক্ষেত্রে তা ডিরেক্ট।

শাফিঃ আপনি ( আমরাও ) বলে থাকেন যে, করাতকল ৩২ পৃষ্ঠার একটি টোটাল টেক্সট। কী ভাবে টোটাল টেক্সট?

কাহুপঃ আচ্ছা বলছি। আমরাতো কমবেশি পেইন্টিংস নিয়ে আগ্রহ রাখি। ধরুন পিকাসোর সেই বিখ্যাত পেইন্টিংস, গোয়ের্নিকা, যেখানে শিল্পী কিউবিজম ফর্মের উপর যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি উপাখ্যান এঁকেছেন। আপনি ভালো করে লক্ষ্য করুন ওখানে কি সবটা চিত্র জুড়েই রঙের কাজ? সেখানে কি ফাঁকা জায়গা লাগেনি? বরং ফাঁকা জায়গাগুলো ছাড়া শিল্পকর্মটি অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে। তো করাতকলকে আমি ঠিক সবটা মিলে একটা কাজই মনে করি। অর্থাৎ করাতকল ৩২ পৃষ্ঠার একটা টোটাল একক বিষয়। ধরুন আপনার একটা রাইটিংস, যার পাশে একটি পেইন্টিংস আছে, যেখানে একটা রেড কালার চলে গেছে পুরো পাতা জুড়ে, তো ঐ  রেড কালারের পাশের শাদা অংশটুকুকে কি বলবেন? ওই শাদাটাকে কি বাদ দিতে পারবেন? পারবেন না। তাই ওই শাটাও টেক্সট। আপনাকে অন্য একটি ধারণা দেই, করাতকলে আপনি যে লেখাটি লিখছেন-বেঙ্গল এর ক্লাসিক্যাল রফস্টিভাল নিয়ে, আমরা দেখেছি কি? দেখেছি অসম্ভব শক্তিশালি কর্পোরেট বলয় বা ছাউনিতে এক সামরিক কায়দায় আমাদের নিরাপদ বানিয়ে ও রেখে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে হয়েছে। বিষয়টি কিন্তু আপনার, আমার চোখে বেশ লেগেছে। এখন আপনি দুই পাতার মধ্যে লিখেছেন এই ফেস্টিভালের অসঙ্গতিগুলো আর তার পাশে একটি শাদা পাতায় শিল্পী একটি কাজ করলো রিলেটেড টোনে। তো শিল্পীর কাজেও শাদা ফাঁকা আছে আবার আপনার লাইন স্পেসেও শাদা জায়গা আছে। সে গুলোকে আপনি কি বলবেন? হ্যাঁ, ওগুলোও টেক্সট। অর্থাৎ সে শাদা অংশগুলো ছাড়া আপনার বিষয় অপরিপূর্ণ। ধরুন একটা শাদা পৃষ্ঠা জুড়ে তারকাটা বেয়ে আরশোলা বাতিল করে দিতে পারেন। ধরুন আমি যে বাজারী কাগজে লিখি না তা কি আমাকে বাতিল করা নয়? উঠিয়ে দিচ্ছেন, তো আশপাশের শাদা জায়গাগুলোকি টেকজস্ট নয়? অবশয়ই। আমি বলতে চাচ্ছি, করাতকলের ৩২ পৃষ্ঠায় আমরা যা লিখি বা আঁকি বা কিছুই করি না সবগুলো মিলেই করাতকল।

ঋষি এস্তেবানঃ আচ্ছা, পথিক’দা। আমিতো অনেক্ষণ ধরে শুনছিলাম। তো দ্রষ্টব্য ও করাতকল আমরা যারা বানাই, তারা বলে থাকি যে, আমরা যে কাউকেই বাতিল করে দিতে পারি। তো এই যে বাতিল করে দেয়া, তার স্পর্ধাটা কোত্থেকে? বা বাতিল করার অথরিটি কে দিয়েছে?

কাহুপঃ আসলে বাতিল করে দেয়া মানে সকল প্রকার প্রচল, গরল, না বণিজ্যিকীপনা, সংস্থা  প্রেম কাহিনি এসব বলতে যা যা আছে বা হচ্ছে তা তো বাতিল করে দিতেই পারি। আসলে অথরিটি মানে আপনার অর্জন। গতো ২২ বছর ধরে আমরা যারা টিকে আছি বা দ্রষ্টব্যকে ধরে একপ্রকার বিপ্লবাত্মক চরিত্রকে এগিয়ে এনেছি, আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, দ্রষ্টব্য ৫, ৬, ৭, ৮ সংখ্যাগুলোতে আমাদের একটা ঊর্ধ্বমুখি প্রক্রিয়া রয়েছে আর রসখানে যারা টিকে থাকতে  পেরেছে তাদের প্রত্যেকেই এক একজন নিজের অস্তিত্বের উপর দাঁড়ানোর ক্ষমতা অর্জন করেছে। আপনিতো জানেন অনেকেই মিছিলের সম্মুখে এসে দলচ্যুত হয়ে ভেসে গেছে। তো তারাতো বাতিলই। ওরকম পদস্খলন হলে যে কাউকেইতো বাতিল করে দেয়া সম্ভব, এমনকি আমাকেও বাতিল করা সম্ভব। এ ছাড়া বাজারী লেখাকে আপনি কি বাতিল করেন না? আপনার কিসের ভয়? আপনিতো আপনাকেই পরীক্ষার মধ্যে রেখেছেন। তো যখন আপনি নিজেকেই বাতিল করে দেয়ার মাঝে রাখেন তখন অন্যান্যরা তো যে কোনো মুহূর্তেই বাতিল মনে করতে পারি। স্পর্ধাতো বাজারে বিকোয় না ভাই তা তো অর্জন করার ব্যাপার। দ্রষ্টব্যের সূচিতে কিছুদিন চরমভাবে থেকে চোখ কান খুলে যাবার পর পূঁজি বাজারের খরিদ্দার হয়ে গেলে আপনি তাকে কী করবেন? আমার কি কোনোকিছু পাবার না হারাবার ভয় আছে? তো আমি কাকে সমীহ করবো? আমিতো নিজেকেই কোনোপ্রকার সমীহ করতে শিখি নি।

ঋষিঃ তাহলে, আমাদের কি শুধু বাতিল করাই কাজ? না ওর মাঝে অন্য কোনো অর্থ নিহিত আছে?

কাহুপঃ তা হবে কেনো? আমাদের কাজতো লেখা। আমরা লিখি, পড়ি, জানি, আর নিজেদের প্রকাশ করি নিজেদের কাগজে। যেহেতু আমাদের নিজেদের একটা দর্শন আছে, আমাদের বাজারী মোড়লীপনার বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ আছে, আমাদের লেখা পড়াগুলো গ্রহণ করার মতো ওদের ক্ষমতা নেই তাইতো লিটলম্যাগাজিন। সে ক্ষেত্রে কাগজের রাগী চেহারার সাথে লেখটাও কিছুটা রাগীসুলভই হয়ে থাকে। আচ্ছা আমি ঋষির সে গল্পটাই বলি যেটা সে প্রায়ই আওড়ায় আর আমি বেশ মজা পাই।
একসময় আমাদের ঋষি কোনো এক সরকারী অফিসে গিয়ে বললো,ঋষিঃ ভাই, আমার এই কাজটা একটু করে দিতে হবে।
অফিসারঃ (শ্লেষ নিয়ে) ভাই কি কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা? যে আপনার কাজটি করে দিতেই হবে?ঋষিঃ না, তা নয়। তবে আমি তারও উপরে?
অফিসারঃ তার উপরে মানে? তার উপরেতো আমাদের ডিজি। আপনি কি সে/
ঋষিঃ আরে না ভাই, আমি তারও উপরে। দেন কাজটি করে দেন।
অফিসারঃ আপনি ডিজিরও উপরে? মাথা ঠিক আছে তো? আপনি তো তাহলে আমাদের মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন।
ঋষিঃ ধরে নিন আমি তারও উপরে।
অফিসারঃ তার মানে মনে হোচ্ছে আপনি মন্ত্রী।
ঋষিঃ আরে ভাই, আমি মন্ত্রী টন্ত্রীরো উপরে। বলছি কাজটা কওে দেন, আমি চলে যাই।
অফিসারঃ মন্ত্রীরও উপর? পাগল মনে হোচ্ছে। তার উপর তো প্রধান মন্ত্রী।
ঋষিঃ ঐ আমি আপনাদের প্রধান মন্ত্রীরও উপরে।
অফিসারঃ আপনি কি রাষ্ট্রপতি? আমি রাষ্ট্রপতি
ঋষিঃ আরে ভাই আমি রাষ্ট্রপতি হবো কেনো? আমি তারও উপরে কিছু।
অফিসারঃ আপনি কি মস্কারা করছেন? আপনি মনে হচ্ছে কোনো পয়গম্বও কেউ?
ঋষিঃ কাজটা করে দিলেই আমি চলে যাই। আর আমি পয়গম্বরেরও উপর।
অফিসারঃ আপনি কি নবি রাসুল?
ঋষিঃ না। তা নয়, আমি নবী রাসুলেরও উপরের কেউ।
অফিসারঃ ঐ মিয়া, আপনি কি তা হলে আল্লাহ? ভগবান? ঈশ্বর?
ঋষিঃ আমি উনাদেরও উপরে, এবার কাজটা করে দেন।
অফিসারঃ ঐ মিয়া, তার উপরে তো কেউ না, তো?
ঋষিঃ ঐ তো, বললাম না। এতোক্ষণে জায়গায় আসছেন। আমি আসলে সেই কেউ না। হোলোতো, এবার কাজটা করে দেন। কাজ করার জন্য উনারদের দরকার হয় না। কাজ করবেন আপনি। এবার কাজ করেন।
এই যে দেখেন। নিজেকে কিছুই না তে পরিণত করা, মানে শূন্যে পরিণত করা। শূন্য কিন্তু একটা কনটেন্ট। কোনো বস্তু যখন শব্দের গতি থেকে বেশি গতিতে চলে তখন কিন্তু বস্তুর ভর শূন্য হয়ে যায়। তা হলে অসম্ভব গতিষ্মান কোনো বস্তু বা কারও কোনো দৃশ্যমানতা থাকে না। করাতকলের বা দ্রষ্টব্যের সকল লেখকরাতো নিজেকে শূন্যই মনে করে। প্রচলিত সমাজ ব্যাবস্থায়, পণ্যায়নের ক্রিয়াকর্মে আমাদের নিজেদের কোনো অস্তিত্ব থাকে না, রাখিও না বরং তাদের জন্য অসম্ভব গতিষ্মান আমরা কিছুটা ভয়ঙ্করও বটে। তাহলে বাতিল করার ক্ষমতাতো আমাদের থাকতেই পারে। 

ঋষিঃ পথিক’দা, আপনি, আমরা বলে থাকি দ্রষ্টব্য ও করাতকল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কাগজ।  তো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠান বলতে কাদেরকে বোঝাবেন?

কাহুপঃ এ প্রশ্নটি কি আজকের নয়, অনেক পুরোনো। আমাদের উচিত এসকল প্রশ্নের উত্তর না দেয়া। বলা, যান পড়ে জেনে নেন। তারপরও বলছি। সাহিত্যে বহু বহু বছর আগে থেকেই যে লিটলম্যাগাজিন ও একধরনের নতুন কিছুর ধারণাটি চলমান ছিলো তা ৮০ এর দশকে ভিন্নতা পায়। সাহিত্য তো আর রাজনীতি বা অর্থনৈতিকতার বাইরে নয়। তাই ধীরে ধীরে অর্থ বা পূঁজি হয়ে উঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। এমনকি সাহিত্যও। সে ক্ষেত্রে সাহিত্যেরও কিছু আড়ৎদার শ্রেণি তৈরি হোলো যেখানে ওদের মতোই সাহিত্য তৈরি হয়। ৮০ এর দশকে এ সকল বিষয় মাথায় রেখেই প্রতিষ্ঠানবিরোধি মুভমেন্ট চলে আসে লিটলম্যাগাজিনে। তখন অনেকে বলতো বাংলাদেশে আনন্দ বাজারের মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, কারণ ছিলো যারা এ বিষয়টা সূত্রপাত করেছিলেন তারাই তাদের দাসত্ব মেনে নিয়েছেন। কিন্তু ৯০ এর দশকে আমরা দ্রষ্টব্যে বলেছি আনন্দ বাজার কিংবা প্রথম আলো চারিত্রিক দিক বিবেচনায় দুটোই এক। অর্থাৎ যে কোনো পত্রিকা কিংবা বুর্জোয়া কোনো সিন্ডিকেট আপনাকে আপনার কথাটি লিখতে দিবে না। বাণিজ্য হয় না তা আপনিও লিখবেন না যদি না আপনি প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রকে উপলব্ধি না করতে পারেন। গোখরা ছোট হোক আর বড় হোক তার আচরণই ছোবল মারা। তাই পূঁজি যখন কিনে ফেলতে চায় সবকিছু তখন আপনার সকল দ্রোহো ও নতুন কিছু করার ক্ষমতাটুকুও গিলে ফেলবে। আর যতোদিন ওদের কাজে লাগবেন আপনি ততোদিন সমাদরে থাকবেন নতুবা আপনাকে রাস্থায় ছুঁড়ে ফেলে দিবেন। প্রচলিত ধারার বাইরে কোনো কিছুই বাণিজ্য করতে পারে না। তাই প্রতিষ্ঠান সেগুলো কখনোই চায় না। আমাদের মিডিয়াতে লক্ষ্য করে দেখেন না, আমাদের চ্যানেলগুলোতে পূঁজির দাপট কেমন, আমাদের টিনএজ মেয়েরা তাদের নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হিমসিম খেতে হচ্ছে, প্রযোজক না চাইলে আউট হয়ে যাচ্ছে তাই হাজার দরজায় তাকে গমনাগমন করতে হচ্ছে। আমাদের লেখকদের বেলায় বিষয়টি ওরকমই। ওরা আপনাকে যতোদিন বাণিজ্য করতে পারবে ততোদিন রাখবে তারপর চিনবে না।

ঋষিঃ তা হলে দ্রষ্টব্য কি সেরকম কোনো পালটা কিছু তৈরি করতে চাচ্ছে?

কাহুপঃ পাল্টা কিছু তৈরি করতে চাচ্ছে কি না তা ভাবছে না, কিন্তু এটা খুবই সত্যি ওদের চেহারাটা উন্মোচন করতে চাচ্ছে এবং দিচ্ছেও। দ্রষ্টব্য কখনো প্রচলিত ধারার লেখার প্রতি আগ্রহী নয়। আপনার নতুন, বেপোরোয়া বা এসব বিষয়-আসয়কে উস্কে দেয়া লেখাটি দ্রষ্টব্য খুব মমতা নিয়েই ছাপে। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন দ্রষ্টব্য তার গত ২২ বছরের অগ্রযাত্রায় কোনোদিন আপোষ করে নি, করবেও না। দ্রষ্টব্য কোনো এক সংখ্যায় আপনি আমার একটা গল্প পড়ে থাকবেন <ইহা একটি কোলবাালিশ বিষয়ক গল্প, যদিও কোলবাালিশ মাঝরাতে কোলবাালিশ থাকে না>। এখন এ গল্পটাতে যমুনা ফিউচার পার্ককে তার বিজ্ঞাপনে তাজমহল, চীনের প্রাচীর কিংবা টুইন্টাওয়ারের সাথে মিলিয়ে ফেলছিলো। মিলিয়ে ফেলার ক্ষমতা পেয়েছে সে পূঁজির জোরে। কিন্তু আমি গল্পটায় ওদের এ উন্মত্ততাকে টেনে হিঁচড়ে উলঙ্গ করে দিয়েছি। আপনি বলে এ লেখাটা কি কোনো দৈনিক কাগজ ছাপার সাহস পাবে? অসম্ভব। আমাদের বুঝতে হবে, কোনটা বড় বা ছোটো প্রতিষ্ঠান তা নয়, মনে রাখতে হবে আমাদের চারপাশে রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর আমাদের চারপাশে অসংখ্য প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র প্রবাহমান রয়েছে আর আমরা তাদের ঠিক বিপরীত স্রোতে এগুতে থাকি, ওদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেই, আমাদের লেখাগুলো ওদের কল্কব্জাগুলোকে চিনিয়ে দিতে সহোযোগিতা করে আর প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাতো কোনো মর্টার নয় যে আপনি যখনই প্রাতিষ্ঠানিক চিত্র দেখবেন আর অমনিই গুলি করে দিবেন। আপনার হাতে আছে ভাষার অস্ত্র, আপনি নিজে লেখক, পূঁজিবাদী মোটাতাজা আর ক্ষমতার দম্ভকে আপনি আপনার লেখায় টেনে রাস্তায় নামিয়ে এনেছেন, কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন কখনো বাতিল ঘোষণা করেছেন। এইটা কি আপনার নিজেকেও প্রচলিত ভোগবাদ থেকে বাতিল করা নয়? তো সে অর্থে আপনি আমি কিংবা দ্রষ্টব্য কি প্রতিষ্ঠানবিরোধি নই বা নয়?

ঋষিঃ পথিক’দা, আসলে আমি অন্যদিকে বলতে চাইছিলাম। আমরা জানি প্রখ্যাত দার্শনিক মিশেল ফুকো প্রতিষ্ঠান বলতে তার পাওয়ারকে বলতে চেয়েছেন। তো সেই পাওয়ারের বিরোধিতা করতে গেলে তো প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাও এক ধরনের পাওয়ার হতে হবে। প্রতিষ্ঠানের পাওয়ার মানেতো মানুষের উপরই মানুষের শোষন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা।  তো ওরকম কিছুর বিপরীতে কিছু করতে গেলে তো বিষয়টা কি পলিটিক্যাল হয়ে যায় না? লিটলম্যাগাজিন এ বিষয়ে কতোটুকু সাহস করে?

কাহুপঃ আসলে পলিটিক্যাল ভিউতো সবকিছুর মাঝেই থাকে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ। রাজনীতি নিজেই একটা সক্রিয়ধারা। কিন্তু শিল্প সাহিত্যও রাজনৈতিক দর্শনের উপর ভর করে দাঁড়ায়। কিন্তু তার অস্ত্র হোচ্ছে তার ভাষা, নিরমান, বিষোয়, প্রকরণ আর প্রতিবাদ। এ ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের মুভমেন্ট আরো বেশি শক্তিশালি কারণ তার প্রতিবাদ সকল বুর্জোয়া চরিত্রের বিপক্ষে। তা ডান কিংবা বাম হোক। যে কোনো ব্যাবস্থাপনার মাঝেই যখন ক্ষমতার শিং বেড়ে উঠে তখন তা কেটে দেবার জন্য আমাদের ভাষা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। সকল যুগেই লেখার ক্ষমতা অনেক পাওয়ারফুল ছিলো। আপনি সমাজের অব্যাবস্থা, অসংগতি, শোষনের বিরুদ্ধে আপনার লেখাকে সক্রিয় রাখেন একদিন অসংখ্য লেখকের লেখা দাঁড়িয়ে যাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে। শোষক শ্রেণি চায় লেখকরা বাণিজ্যিক লেখা লিখুক, খুকু গদ্য লিখুক, রং-তামাশায় মেতে থাকুক আর লেখকদের তারা কিনে ফেলুক। তাতে মানুষ ঘুমোবে আর সমাজ ব্যবস্থা তাদের বইঠকঘর হয়ে যাবে। রাষ্ট্রব্যাবস্থাপনা কোনো কালেই খুব ক্ষুরধার ও মেধাবী লেখকদের চান না আর চাইলে তারা তাদেরই সেবাদাশে পরিণত করে রাখতে পছন্দ করেন। আমাদের হুমায়ুন>জাফর ইকবাল>সাবের >মিলন এ ধরনের বাজার কাটতি ব্যাবসা সফল লেখকরা পারে আমাদের সমাজ ব্যাবস্থার মধ্যে বিপ্লবাত্মক একটা শ্রেণি তৈরিকে দমন করে রাখা। এর বেশি হলে কিছু ম্যাডেল গলায় ঝুলিয়ে দিইয়ে লেখকদের নিজের করে নেয়ার ব্যবস্থাতো আছেই। আপনি প্রচলিতধারার বাইরে কিছু করার প্রবণতা খুব দেখবেন না। কিন্তু আপনি লিখছেন না কি? তো এটা কি প্রতিবাদ নয়? মিশেল ফূকো যে ক্ষমতার কথা বলেছেন সে ক্ষমতার প্যারালাল ক্ষমতার কথাই আমাদের লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টের মাঝে বলছি।

শাফিঃ পাত্তা না দেয়ার কারণটা কি?

কাহুপঃ কারণ, তারা ব্যাবসায়ী। শিল্প কি ব্যাবসার পণ্য? আপনার কবিতা কি আলু পটল? আমি যখন পড়ি বা শুনি, বেস্ট সেলার বা বই খুব বিক্রী হচ্ছে তখন বমি চলে আসে। খুব বিক্রী হচ্ছে এমন একটা বই আপনি এনে দেখেন না ওটা কি? ওটা যে কোনো মৌলিক কিছু নয় তা হলফ করে বলতে পারি। আর একটা পাবেন বড় কোনো শক্তি কোনো কিছুকে বাণিজ্যিক আদলেই বাজারে এনে ব্যাবসা করে নিচ্ছে। যেমন আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে বা লালনকে নিয়ে বা অদ্বৈত মল্ল বর্মণ কে বাজারে নিয়ে আসা। আপনি দুটোকেই বাতিল করছেন। কারণ ওদের উদ্দেশ্য কখনই ঐ সকল লেখকদের ধারে কাছে নেই।

শাফিঃ এক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন আসছে যে, আমাদেও যে প্রকাশনা, করাতকল থেকে ছোটোকাগজের লেখকরা তাদের অবাণিজ্যিক চিন্তা থেকে নিজেদের পয়সা খরচ করে নিজেদের ব্যাবস্থাপনায় নিজেরাই বই বিক্রী করে। তো বাণিজ্যিক প্রকাশনার পাশে  ছোটোকাগজের লেখকদের প্রচার বা পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়া এই দিকটাতে অনেক পিছিয়ে থাকাটাকে কি হিসেবে দেখছেন? এতো বড় বাজারের বিরুদ্ধে ছোটোকাগজের প্রকাশনা কতোটুকু লাভজনক হওয়া যাবে?

কাহুপঃ শাফি, আপনি কি লাভের জন্য লিখছেন? আর আপনার তো পাঠকও সীমিত। আপনার বইতো খুঁজেই কিনবে আর আপনি ওদের সাথে কি প্রতিযোগিতা করতে চান? মোটেই না। আপনিতো ওদের চিন্তা চেতনা ব্যাবসা মুনাফার বিরুদ্ধেই আছেন। তো ওদের সাথে কোনোরকম হিসেব নিকেশের মাঝেই আপনি নেই। ব্রিটিশদের উপর গ্রেনেট নিক্ষেপের জন্য ক্ষুদিরামতো একজনই ছিলো। তো ওর কি হয়েছে? ফাঁসি। এখন এ বিষয়টাকে আপনি কি ভাবে দেখবেন? আফ্রিকান কবি বেঞ্জামিন মোলোয়েসীকে আপনি কিভাবে দেখবেন? তাকেতো ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেছে রাষ্ট্রব্যাবস্থা। তো করাতকল একটা প্রকাশনা এবং নিজেই একটা ইশতেহার। করাতকলতো কাউকে প্রতিযোগী বা সমযোগীও মনে করে না। পুঁজিবাদী বুর্জোয়া আর বাজারী ব্যাবস্থাপনার বিরুদ্ধে তার অবস্থান। করাতকল থেকেতো আপনার খুকু গদ্য বা বালিকাদের প্রেমের কবিতা বা লাল নীল উপন্যাস বের করা হবে না বরং আপনার কোনো ভয়ঙ্কর গ্রন্থটি বের করার পীঠস্থান হচ্ছে করাতকল। করাতকল মাত্র ২ টা সংখ্যা করেছে। তার মাঝেই অনেকের দৃষ্টি করাতকলের দিকে। আপনি ভাবুন না রবির কাছে বিক্রী হয়ে গেছে বাংলাদেশের পতাকা যে ছবি ও ক্যাপশন দিয়ে করাতকল এর যাত্রা এ দুঃসাহস আর কে দেখিয়েছে? বরং আমরা পরখ করেছি রবি কোম্পানির লোক, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা এর কপি নিয়ে গেছে। তার মানে কি? কাজটি সহজ নয়। কিন্তু যা করেছি তা খুবই জরুরী মনে হয়েছে আমাদের। তো আপনি বললেন রাজশাহীতে কেউ নাকি এ কাগজটি দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। তো যদি দেশের ১০ টি শহর থেকে এ রকম চিন্তার ১০ টি ইস্যু বের হয় তো কারোও টনকতো নড়ার কথা। নয় কি? ঋষি এস্তেবানের একটা কথা থেকে বলি, তা হলেতো এটাও একটা প্রতিষ্ঠান। না, প্রতিষ্ঠানতো থাকেই আপনি প্রাতিষ্ঠানিক মধ্যবিত্তীয় বুর্জোয়া চরিত্রকে আপনিই আপনার, আমাদের এবং কাগজের মাঝে ঠাঁই দিচ্ছেন না বরং তার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এটা একটা চিন্তার ঐক্যের জায়গা। একটা শক্তিকে আক্রমণ করার জন্য আপনার আছে শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যম। আপনি যে কোনো একটা দিয়ে তা প্রকাশ করেন।

শাফিঃ করাতকল কি নিজেদের আত্ম-ধ্বংসী কোনো কারখানার নাম?

কাহুপঃ সেমতোই ধরতে পারেন। আপনি তো জনপ্রিয় হতে আসেন নি। সুবিমল বাবুর একটা কথা কোড করছি, আমি যখন দেখছি আমি জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছি তা হলে বুঝতে হবে আমি নতুন কিছু করছি না। আমরা তো নিজেদের বাতিল করার জন্য সবসময়ই প্রস্তুত রাখি। অন্য ১০ জন থেকে আপনি আলাদা করে দেখতে শিখেছেন তাই আপনার লেখা নরোম তুলতুলে হয় না, বরং তা হয়ে পড়ে বিশ্রী ও কর্কশ। তাই আপনি পপুলার থাকেন না। যেমন আপনি ক্লাসিক্যাল ফেস্টিভাল দেখতে গিয়ে দেখেছেন এক বাণীজ্যিক চাতুরী। কিন্তুদেখতে গিয়েছে কিন্তু অসংখ্য লোক। এই যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আয়োজনের ভারতীয় ও দেশীয় এতো বড় আয়োজনের পেছনে কোটি কোটি টাকার সংস্থান করেছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো আর নিরাপত্তার জন্য ব্যাবহার করা হয়েছে পুলিশ, র‌্যাব, গোয়েন্দাসহ অনেক কিছু। আপনি আমাকে বোঝান, একটি সামরিক প্রহরায় অস্ত্র শস্ত্রের ভেতর কীভাবে আপনি উপভোগ করবেন হরিপ্রসাদ চৌরশিয়ার বাঁশি? আপনি কিন্তু এ নিয়ে কিছু লিখছেন করাতকলে। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কিন্তু মৌলিক কিন্তু তার আয়োজন বাণিজ্যিক। এর ভেতর দিয়ে নিজেদেরকে প্রচারের সীমানায় নিয়ে যেতে এ আয়োজন খুবই মহান। তো আপনি আমি এরকম ভাবছি কিন্তু আর কে ভাবছে? তো আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আপনার লেখার মাধ্যমে কিছু লোকের কাছে পৌঁছুবে এবং তা মাত্র ২/৩ পাতার একটা লেখার মাধমে পৌঁছে যেতে কোনো বেগ পেতে হবে না। তো আপনিতো ডিফারেন্টই। আসলে করাতকল যেনো নিজেকে জবাই করার একটা প্রথম জায়গা। তাই বলছিলাম সকল প্রকার বেণিয়া বৃত্তির বিরুদ্ধে আপনি লড়তে এসেছেন। রবি কিন্তু অনেক বেশি একটি শক্তিশালি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আপনি লিখতে ছাড়েন নি তাদের ব্যাবসার ফন্দিফিকিরির কথা। আমাদের কষ্টার্জিত পতাকাকে ওরা টাকার বিনিময়ে নিজেদের করে নিয়েছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর গায়ে রবির লেবেল সেঁটে দিয়েছে আর ঐ পতাকা শধু ওরা তাদের বিজ্ঞাপনেই ব্যাবহার করেছে। কিন্তু আমরা বলেছিলাম ওরা ঝুলে থাকা পদ্মা সেতু করে দেবে না। দেবে যদি ওদের ধান্দা ওদের মতো হয়। কিন্তু এ নিয়ে কি কোনো ছোটোকাগজ কোনো কথা বলেছে? বলে নি । তো আপনি কি আত্ম ধ্বংসী নন?

শাফিঃ শেষে অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি, করাতকল এবার ৩য় সংখ্যা হিসেবে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো থিম ঠিক করা হয়নি। তো কোন বিষয় নিয়ে এবার মূখ্য দিক থাকবে তা কি ভেবেছেন? শেষে অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি, করাতকল এবার ৩য় সংখ্যা হিসেবে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো থিম ঠিক করা হয়নি। তো কোন বিষয় নিয়ে এবার মূখ্য দিক থাকবে তা কি ভেবেছেন?

কাহুপঃ হ্যাঁ। করাতকল এর কোনো নির্দিষ্ট বিষয় এখনো ঠিক করা হয় নি। আসল কথা হোলো করাতকল তার মতো করেই বের হবে। কিন্তু আমরা জানি আমাদের একটা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি আছে। ফলে অনেক কিছুই আছে যা এবারের করাতকলে উঠে আসতে পারে। আমাদের চোখে অসংখ্য অসঙ্গতি ধরা পড়ে যা অন্যদের চোখে পড়ে না। 
কিছু সে রকম বিষয় নিয়েই না হয় কথা বলি।

১। আপনি কোনো চ্যানেলের খবর ভালো করে দেখবেন, খবরের কতো ইঞ্চি কতোজনের কাছে বিক্রী করা। দেখবেন একটা খবরকে কী ভাবে আমাদের পূঁজিবাদী ব্যাবস্থাপনা বাণিজ্যিক করে ফেলেছে। মুনাফা লুটে নেয়ার জন্য বিজ্ঞাপনের মতো একটা সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি থাকতে হয়। আমিতো বিজ্ঞাপন কে মহা প্রতারক বলি। তো এই প্রতারককে প্রশ্রয় দিচ্ছে কারা? এক চুলের জন্য কী ভাবে টাকা খসিয়ে নিতে হয় আর নারীদের কী ভাবে পণ্য বানিয়ে ফেলা হয় তাও তো হতে পারে এবারের বিষয়।

২। বাংলা একাডেমির বইমেলা ধরুন। বইমেলা এলেই যে নজরুল মঞ্চকে ঘিরে নব্য কবি গল্পকারদের (বড়দেরও) বইয়ের মোড়ক উন্মোচন কম্মটি শুরু হয় তা কি আদৌ কোনো দরকারী? একসময় কোন প্রকাশিত বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হোতো। তারপর কে বা কারা তার নাম করেছে মোড়ক উন্মোচন। মোড়ক উন্মোচন শব্দটিকেই আমার কাছে অশ্লীল মনে হয়। এখানে খুব সঙ্গোপনে একটা ভেজাল সিন্ডিকেট অবস্থান করে। কার বই আজ উন্মোচইত হবে? কে উন্মোচন করবেন? কী ভাবে উন্মোচন করবেন? কী বিনিময় হবে উন্মোচনের জন্য? নজরানা কতো? এ ছাড়াও আরও কিছু বিষয় না হয় নাই বললাম।

৩। বাজারী ব্যাবস্থাপনার মাঝে বিজ্ঞাপণ নিয়েতো আমাদের অনেক কিছুই বলার থাকে। বিজ্ঞাপনের বিষয় কি হচ্ছে? এ নিয়ে এখনো রাষ্ট্রের মাথাব্যাথা হোচ্ছে না। কিন্তু আপনি কি লক্ষ্য করেছেন, আমাদের মোবাইল কোম্পানিগুলো ছাড়াও বড় দাগের বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপনের বিষয় হিসেবে ব্যাবহার করছে দেশের মূল বিষয়গুলোকে। তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? যখন জাতি নিয়ে কেউ কোনো কথা ব্যাবহার করে বিজ্ঞাপন বানিয়ে সরকারকে টাকা দিচ্ছে, সরকার তার বিরুদ্ধে কি কিছু ঝুঝতে পারছে সহজে? আচ্ছা আপনি বলুনতো, বাংলা একাডেমির মূল ফটক তৈরির জন্য কি সরকারকে বসুন্ধরা গ্রূপের কাছে যাওয়া খুব দরকার ছিলো? না উচিৎ কি? ‘দেখে আসুন মূল ফটকে লেখা- সৌজন্যেঃ বসুন্ধরা গ্রুপ।



Post Bottom Ad

Responsive Ads Here

Pages