উৎসর্গঃ কবি সুনীল সাইফুল্লহ (১৯৫৭-৯৮১)
এ জন্ম মিথ্যে, সত্যমুকুট ছাড়া একদিনও বাঁচবো না আর
পাপিষ্ঠ পুণ্যপটে রেখে যাই শেষ অহংকার
-কবি সুনীল সাইফুল্লাহ
দ্রষ্টব্য ১৪ উৎসর্গ করা হলো আশির দশকের শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আত্মহণনের এক প্রখর মেধাবী ছাত্র ও কবি সুনীল সাইফুল্লাহকে যার আয়ুষ্কাল পেয়েছিলো মাত্র ২৪ বছর। তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের পা-ুলিপি ‘দুঃখ ধরার ভরাস্রোত” সম্পূর্ণ মুদ্রিত হোলো তার উপর একটি আলোচনাসহ। পুনরায় পাঠের আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদ এর অমায়িক খচ্চর ও কান্নাঘর মুদ্রিত হলো। এ শতাব্দীর ১ম দশকের গোড়ার দিকে (২০০২) রচিত ও গা-ীবে প্রকাশিত তাঁর অমায়িক খচ্চর বাংলা ভাষার গদ্য ও গল্প সাহিত্যের এবং স্বাধীনতা পূর্ব ও তৎপরবর্তি এদেশে লিটল ম্যাগাজিনের বিবর্তনের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে পাঠক সাম্মক ধারণা পাবে এবং শেষ দিকে (২০১০) রচিত ও প্রতিশিল্পে প্রকাশিত কান্নাঘর গল্পে তৎসময়ে বোদ্ধা পাঠককে নাড়া দিয়েছিলো একটা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যাপনচিত্রের এক অসামান্য দ্রোহ ও সংগ্রামের চিত্রায়নের মৌলিকত্বে। কোলকাতার অন্যতম প্রতিষ্ঠানবিরোধী কাগজ গ্রাফিত্তি’র সম্পাদক ও লেখক শুভঙ্কর দাশ-এর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সূচিবদ্ধ হোলো যা নয়া প্রজন্মকে লিটলম্যাগাজিন ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্প-সাহিত্যে আন্দোলনের ধারণাক স্পষ্ট করবে। তা ছাড়া শুভঙ্কর দাশ-এর চার্লস বুকাওস্কির অনুবাদসহ ৩ গল্পকারের গল্প, তনুজ সরকার-এর কাব্য নাটক আফ্রিদাহোল, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প পাঠ নিয়ে স্বাত্ত্বিক নন্দী’র গদ্যসহ ৪ গদ্যকারের উপস্থিতি, উল্লেখযোগ্য ৬ কবির সিরিজ কবিতা আর দ্রষ্টব্য সূচিতে সর্বকনিষ্ঠ কবি আব্রাহাম তামিম সহ ১৬ কবির গুচ্ছ কবিতা নিয়ে দ্রষ্টব্য ১৪ তার নিজের অবস্থান সুদৃঢ় রাখার চেষ্টা করেছে। দ্রষ্টব্য সূচিতে অন্তর্ভূক্তি হোলো আব্রাহাম তামিম, প্রাচ্য মোহাম্মদ, মাহমুদুল হাসান মাছুম আর আব্বাস উদ্দীন হেলাল।
বেঁচে থাকার সাথে স্বপ্নের কোনো যোগসূত্র
নেই তবু স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্ন দেখেছিলো স্বপ্নের সারসেরা
স্বপ্নই একটা মহাকাশ... একটা মহাকাল... সৃষ্টি আর প্রলয়ের মধ্যবর্তি দূরাগত কোনো উপাখ্যান। সৃষ্টিশীল অগ্নি যন্ত্রণায় দগ্ধ ফিনিক্সের বিনাশ আর নয়া প্রত্যয়ের দ্রষ্টার পুনর্জন্মের বিস্ময়। যারা স্বপ্ন দেখতে জানে না, তারা মহাকাশ ভ্রমণ করতে জানে না...যারা স্বপ্ন দেখতে পারে না, তারা প্রলয় নৃত্যের নন্দন দেখতে পারে না... যারা স্বপ্ন দেখতে জানে, তারা মহাকাল দেখতে জানে... যারা স্বপ্ন দেখতে পারে, তারা আগ্নেয়গিরির শোলকসন্ধানে পাতাল ভ্রমণ করতে পারে। এ সকল স্বপ্নের সারসেরা প্রচল আর সরল ¯্রােতের বিপরীতে চলমান দ্রোহের এক পরিভ্রমণকারী স্বাপ্নিক দল, যারা নিজেদের বার বার দাঁড় করিয়ে দিতে অকুণ্ঠিত মৃত্যুর ইন্দ্রজালে।
শিল্প এক প্রাণসঞ্চারী অমীয় সুধাসুরার নাম
তাই নিজেরে ভেঙেচুরে রাখি বিনির্মাণে চলমান
প্রকৃত অর্থে শিল্প ও শিল্পী শূন্য ব্যাবধানে থাকে পরষ্পর মুখোমুখি ও আক্রমণাত্মক। বাজার-মুনাফা কিংবা পন্য-পন্যায়নের মুক্ত বাজারের প্রতিযোগিতায় নেংটি পড়ে হিট ট্র্যাকে ওঠার ম্যানিপলিউটেড বিশ্বায়নের চোরাবালির খপ্পর থেকে বেঁচে থাকার জন্যে একে অপরের পাহারাদার হয়ে থাকে। পরষ্পর নিজেদের নিমগ্ন রাখে ধ্যানবিন্দুতে, থাকতে চায় সৌরম-লের কোনো ছায়াপথ হয়ে যদিও ধ্যান-বিচ্যুতির উদাহরণ ক্রমশঃ ছিলো আছে এবং থাকবে। কিন্তু তা আমলে রাখে না, যে বা যারা থাকে নির্মাণে-বিনির্মাণে নিজেরে বিপন্ন করার কর্মযজ্ঞে। এ যেনো এক একমুখি যাত্রা, সম্মুখে খরস্রোতা নদী কিংবা বরফের খাড়া ঢালে নিজেকে বিপন্ন করার মন্ত্রে উজ্জীবিত থাকে অগ্রসরমান। হয়তো বা কোনোকালে বরফের হিমখাদে সুরক্ষিত নিঃসার দেহের ক্ষতচিহ্নে আবিষ্কৃত হবে তাদের একমুখি যাত্রার এপিটাফ।
দূরগাও থেকে অতিথি পাখিরা আসে ফিরে যাবার জন্যেই
কেউ কেউ থেকে যায় লোভ-লালসার মেডেলের ভেলকিবাজী প্রত্যাক্ষ্যান করে
ধর্মীয় ব্যাবসায়ীদের মতো শিল্প সাহিত্যের খানকা শরীফ বেড়ে চলছে গাণিতিক হারে। শিল্পকর্মের চেয়ে গুরুত্ত্ববহ হয়ে উঠছে ম-া-মিঠাই-আড়ং-এর ব্যাগ-গিলাপ-গোলাপ আর উত্তরীয় নামক অভিজাত শব্দ-বস্তুর সম্ভার। কবি-কবিতা-পাঠ-সংগীত-্শরীর-ব্যাঞ্জন-ডুগডুগি সবমিলে এ যেনো এক শীতকালীন ওরসের মরশুম। বিবিধ দেশীয়-আন্তর্জাতিক লিট-ফেস্ট থেকে বনেদী বিশ্ব-সাহিত্যের পানশালা আর সমুদ্র বিলাসে তবলীগে দিনভর আশেকানদের কবিতার বয়ান আর অজিফা পাঠ। অতঃপর আহা! উহু! সমাচার। এর মাঝেই ভাষা ও শিল্পকে বাঁচানোর কর্মে নির্মোহিক অবিরত যাত্রায় স্বপ্নের সারসেরা থাকে দীপ্তমান শিল্প সাহিত্যের নয়া মহাকাশের মহালোক সন্ধানে। কে গেলো, কাকে বাতিল করা হোলো তা কোনো অর্থেই বিবেচ্য বিষয় নয়, বিষয় আব্রাহাম তামিম-এর মতো কেউ, যার আত্মদর্শনই যথেষ্ট হতে পারে আমাদের অগ্রজদের জন্য আশাবাদ... আছি... আসছি... আমি... আমরা... ভাষা ও শিল্পের বাঁচানেওয়ালা...
দ্রষ্টব্য ১৪ কুড়িগ্রামের ‘শাব্দিক’ এর অগ্রযাত্রাকে সাধুবাদ আর খুলনার ‘যশোর রোড’-এর যাত্রাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।